দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২৫ মে, ২০১৮

বিশ্লেষণ

যানজটের অভিশাপ

রাজধানীর যানজট মেগাসিটি ঢাকার দেড় কোটি মানুষের জন্যই শুধু নয়, দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে বললে বেশি বলা হবে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ‘গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং যানজট নিরসনের পরিকল্পনা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তি ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজধানীতে যানজটে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজট যে রাজধানীবাসী বা মোটা দাগে দেশবাসীর জন্য কতটা অভিশাপ হয়ে উঠেছে, প্রতিদিন অন্তত ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার বিষয়টিতে তা স্পষ্ট হয়।

চালকদের আচরণবিধি লঙ্ঘন রাজধানীর যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। ফুটপাথ দখল করে দোকানপাট বসানো, যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিংও যানজটের বড় কারণ। রাজনৈতিক লেবাসধারীরা যানজটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। ফুটপাথ দখল করে যেসব দোকানপাট বসিয়ে রাজনৈতিক নেতারা ভাড়া আদায় করে। উল্টো পথে গাড়ি চালানোও কঠোরভাবে দমন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যানজট নিরসনে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও জরুরি। রাজপথে মিছিল-মিটিং ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন বন্ধ করতে হবে। যানজট নিরসনে সবকিছুর আগে চাই সদিচ্ছা। বাস-ট্রাক মালিকদের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের গোপন সমঝোতা বন্ধও যানজট নিরসনের জন্য জরুরি। যানজটের কারণে অনেক মরণাপন্ন রোগীকে সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয় না। এ পরিস্থিতি যে কত মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। তাছাড়া রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে সৃষ্ট ভোগান্তিতে অনেক সুস্থ মানুষও শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। যানজটের কারণে মানুষের পক্ষে নির্ধারিত সময়ে কোনো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। নগরীতে বায়ুদূষণের বড় কারণ যানজট। এর পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যে। কাজেই যানজটের ক্ষতি শুধু কর্মঘণ্টা বা অর্থমূল্য দিয়ে নিরূপণ করলে চলে না, সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে একে মোকাবিলা করতে হবে।

বস্তুত যানজট এখন ঢাকা মহানগরীর প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। নগরীর লোকসংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যাও। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি সড়কের সংখ্যা ও পরিধি। এজন্য নীতি নির্ধারকরাই দায়ী। তারা সময় থাকতে দূরদৃষ্টি নিয়ে নগর পরিকল্পনাকারীদের কাজে লাগালে যানজট পরিস্থিতি আজ এতটা জটিল আকার ধারণ করত না। সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় নগরীতে গাড়ির সংখ্যা বাড়লেও গণপরিবহন সংকট হয়েছে তীব্র। গণপরিবহনের সংখ্যা ও সেবার মান বাড়লে এবং এ খাতে অরাজকতা বন্ধ হলে রাজধানীর সড়কে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি নামানোর প্রয়োজন হতো না। বস্তুত পরিবহন খাতে বিদ্যমান ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা যানজটের একটি বড় কারণ, যার পেছনে কাজ করছে গোষ্ঠীস্বার্থ। সরকার এদিকে নজর দিলে এখনও যানজটের তীব্রতা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করা কোনো অলৌকিক বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, যানজটের কারণে রাজধানীতে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ। যানবাহনের সংখ্যা যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এ নগরীতে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম। দেশের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ের অবস্থান ঢাকায় হওয়ার কারণে রাজধানীর ওপর চাপ বেড়েছে। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। একইভাবে ঢাকা ও এর আশপাশে অবস্থিত কলকারখানাগুলোও দূরবর্তী সুবিধাজনক স্থানে সরিয়ে নেওয়া দরকার।

ভয়াবহ যানজট রাজধানীর বাসযোগ্যতা ক্রমেই কমিয়ে দিচ্ছে। এ সমস্যা নিরসনে অনেক সভা-সেমিনার হয়েছে, হয়েছে গবেষণা। দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চালানো হয়েছে সমীক্ষা। কিন্তু সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সামান্যই। কিছু নতুন সড়ক ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করে যে রাজধানীর যানজট সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়, এটা এখন পরিষ্কার। এ নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে প্রয়োজন ব্যাপক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগী ভূমিকা কাম্য।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist