ডা. এস এ মালেক

  ১৯ মে, ২০১৮

মতামত

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

মহাবিজয়। বাংলাদেশের মতো একটা উন্নয়নশীল দেশে এত ব্যয়বহুল একটা প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো প্রয়োজন ছিল কি? এমন প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে। জবাবে বলতে হয়, বাস্তবতা হচ্ছে বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মূল বাজেট প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার স্যাটেলাইট প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য কোনো অকল্পনীয় বিষয় নয়। এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগব্যবস্থা আন্তর্জাতিকীকরণ হবে না বরং বিদেশকে স্পেস ভাড়া দিয়ে আমরা বিপুল অর্থ আয় করতে সক্ষম হব। ভূমি থেকে উড়ে যাওয়ার পর আট দিন মহাকাশে ৩৬ হাজার কিমি পথ অতিক্রম করে নিজস্ব কক্ষপথে অবস্থান নেবে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৫৭তম রাষ্ট্র। তথ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এ ঘটনা নিশ্চয়ই উৎসাহব্যঞ্জক। তরুণসমাজ গভীর আগ্রহ নিয়ে দৃষ্টি রাখবে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রতি। স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে। প্রবাসী অগণিত বাঙালি সেখানে সমবেত হয়েছিল। আর দেশে চলেছে তরুণদের মহোৎসব। বাংলাদেশিরা এর আগেই ফ্লোরিডায় অবস্থান নিয়েছেন। এই স্যাটেলাইটের ওজন হবে ৩ দশমিক ৭ টন। ১৫ বছর সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে বিচরণ করবে স্যাটেলাইটটি। ১৫ বছর পরে আরো তিন বছর এই স্যাটেলাইটটি কার্যকর থাকবে। আসলে ফ্লোরিডা থেকে এটা উৎক্ষেপিত হলেও এর উৎক্ষেপণে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যাতে তারা এই স্যাটেলাইটকে নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন।

বর্তমানে বাংলাদেশে দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন আছে। বেতবুনিয়ায় ও গাজীপুরে। গ্রাউন্ড স্টেশন এই স্যাটেলাইটের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের জলরাশির নিচে যে মূল্যবান সম্পদ রয়েছে, তা আমরা জানতে পারব। ফলে সম্পদ আরোহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক সুবিধাজনক স্থানে পৌঁছে যাবে। তিনি আরো বলেছেন, বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে এই স্যাটেলাইট এমন ভূমিকা রাখবে যাতে বিভিন্ন সিগন্যালের মাধ্যমে এই বিশাল জলরাশির কোথায় কী ঘটছে; তা ধরা যাবে। তথ্যপ্রযুক্তির সংকটগুলো সমাধান করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া দেশের সুদূর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে হাওর, জলাভূমি ও পর্বতময় জঙ্গলের অবস্থানে যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ঘটানো এখনো সম্ভব হয়নি, সেখানেও সরাসরি এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। আসলে স্যাটেলাইট থেকে যে সংকেত আসবে তা রিসিভ ও ইন্টারপ্রেট করার মতো প্রযুক্তি আমাদের অবশ্যই অর্জন করতে হবে। গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনটি এভাবেই নির্মিত হয়েছে। মনে হয় দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যেই এই স্টেশনটি যোগাযোগের মাধ্যমে সিগন্যালগুলো ট্রান্সমিট করতে পারবে। স্যাটেলাইটে যে ব্যয় হয়েছে; তার ৫০ ভাগের বেশি বাংলাদেশ নিজস্ব তহবিল থেকে বিনিয়োগ করেছে। আমরা যে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল এবং উন্নত দেশের খাতায় নাম লেখাতে সক্ষম হযেছি; তা এই সফল উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রমাণিত হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি যা বলেন, তা করে থাকেন। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পরিকল্পিত যে প্রকল্পটি তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি, সেই প্রকল্পই তারই মেয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা এবার বাস্তবায়ন করলেন। শুধু স্যাটেলাইট-১ নয়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে যা যা করার পরিকল্পনা করেছেন শেখ হাসিনা, একে একে তা বাস্তবায়ন করেছেন; না হয় উদ্যোগ নিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের প্রয়োজন-প্রত্যাশা পূরণ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। আর এটা করতে গিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তিনি যেভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন; তা একমাত্র শেখ হাসিনার মতো দৃঢ়চিত্ত, সাহসী, দেশপ্রেমিক নেত্রীর পক্ষে সম্ভব।

তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক অসাধারণ অবদান রাখবে। সাহিত্যের ছাত্রী হয়ে বিজ্ঞানমনস্কতা শেখ হাসিনাকে নাড়া দিতে পারার একমাত্র কারণ দেশপ্রেম। দেশের মানুষের প্রতি গভীর অঙ্গীকার ও ভালোবাসায় তিনি যা কিছু করেন, জনগণের ভালোবাসার টানে ও প্রয়োজনেই তা করেছেন। এর পরও এই স্যাটেলাইট নিয়ে অনেক কথাবার্তা হবে। যাদের চোখে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ধরা পড়ে না; যাদের একমাত্র বক্তব্য হচ্ছে শেখ হাসিনা ও তার দল দেশের সম্পদ লুটপাট করে খাচ্ছে; বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মতো এত বড় একটা জাতীয় সফলতা তাদের মনে বিন্দুমাত্র উৎসাহ আগ্রহের সৃষ্টি করে না। তারা তাদের মতো করে নেগেটিভ কথাবার্তা বলে চলেছেন। হয়তো বলতে ছাড়বে না এটা একটা অপব্যয়, বিলাসবহুল প্রকল্প; যা শুধু রাজনৈতিক কারণে শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এই উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে গৌরব অর্জন করল তাতে জাতি হিসেবে গর্ববোধ করার মতো মানুষের সংখ্যাও কম নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থাশীলতা আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় সাফল্য পশ্চিমা দেশগুলো ও ইউরোপীয় দেশগুলো যখন উন্নতির চরম শিখরে, আমরা তখন অনেক পেছনে পড়ে আছি। আজ সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কত প্রয়োজনীয় হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমরা এর থেকে পিছিয়ে থাকতে পারি না। বাংলাদেশ সরকার কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠানোর মাধ্যমে প্রমাণ করেছে দেশ আজ জল, স্থল ও অন্তরীক্ষে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞানের সুফল কাজে লাগিয়ে আমাদের টেলিযোগাযোগখ্যাত নতুন যুগে প্রবেশের মাধ্যমে আমরা আমাদের সক্ষমতাকে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে পেরেছি। স্বাধীনতার পর বলা যেতে পারে এটা বড় অর্জন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ লেখাও বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম এবং লাল-সবুজের রকেটটি মহাশূন্যে সফল পরিভ্রমণ ও কক্ষপথে ঘোরার মাধ্যমে বাংলাদেশ সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মহাকাশ বিজয়ের আনন্দ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আরেকধাপ সফলতা। একে একে বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হোক, সেই প্রত্যাশা রইল। এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এই প্রকল্পের সুফল সম্পর্কে দেশবাসী ও জনগণকে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বোঝাতে হবে। অনেকে এই প্রকল্পের সুফল সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ও কোনো ধারণাই নেই। কৃত্রিম উপগ্রহ ভাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বার্ষিক আয় হবে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার, যা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এত দিন আমরা সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় বছরে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয় করতাম টেলিযোগাযোগ খাতে। উপগ্রহটি স্থাপনের পর এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে ব্যয় করা থেকে রক্ষা পাবে দেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারকে অভিনন্দন। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এ স্যাটেলাইট একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist