রহিম আবদুর রহিম

  ২৫ এপ্রিল, ২০১৮

পর্যালোচনা

শিশু অধিকার ও বাস্তবতা

নবাগত প্রাণকে ভালোবাসে না, আদর দেয় নাÑএ রকম প্রাণী পৃথিবীতে বিরল। মানবসভ্যতায় শিশুর প্রতি ভালোবাসা প্রকট। এর পরও শিশুরা অধিকার বঞ্চিত হয়ে আসছে। কারণে-অকারণে, অভাব-অনটনে, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বা সচেতনতার অভাবেই প্রতিটি মানুষের আশপাশে, ঘরে-বাইরে, শিক্ষা-দীক্ষায়, চলা-ফেরায়, খেলাধুলায় আমাদের শিশুরা তাদের অধিকার পাচ্ছে না। শিশুদের ঘিরে আছে নানা বৈষম্য। প্রতি বছর ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু, ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিশু অধিকার এবং ৩ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস পালনের মধ্য দিয়ে শিশু জীবনের কল্যাণের প্রচার-প্রচারণার মহৎ উদ্যোগটি বাস্তবতার সঙ্গে কতটাই বা সংগতিপূর্ণ? শিশুর অধিকার সুনিশ্চিত করতে জাতিসংঘ শিশু অধিকার (ইউএনসিআরসি) ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সনদে পৃথিবীর ১৯৩টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। ১৯৯০ সালে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। আমাদের শিশুরা বরাবরই ভালো ছিল এবং আছে। পূরণ হচ্ছে না আমাদের শিশুদের অধিকার। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের চার মূলনীতি বৈষম্যহীনতা, সর্বোত্তম স্বার্থ, বেঁচে থাকা ও বিকাশ এবং শিশুদের অংশগ্রহণ। এ ক্ষেত্রে চার মূলনীতির সঙ্গে শিশুদের অধিকারের বাস্তবতার চিত্রের ফারাক পর্বতসম। বৈষম্যহীনতায় গোত্র, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক ভিন্নমত, জাতীয়তা কিংবা সামাজিক পরিচয়, শ্রেণি, জন্মসূত্র কিংবা অন্য কোনো মর্যাদা নির্বিশেষে প্রতিটি শিশু কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই এ ঘোষণার সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু তা কি কোনো শিশু ভোগ করতে পারছে? একজন শিশু জানে না তার অধিকার নীতিতে কী আছে। যিনি বা যারা জানেন, তারা, তার শিশুর অধিকার কতটুকু বাস্তবায়ন করছেন।

সাজিদ এখন মাস্টার্সে লেখাপড়া করছে। ও ক্লাস থ্রি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমার নাট্যগোষ্ঠীতে কাজ করেছে ও যখন চতুর্থ শ্রেণিতে, ওর বাবা-মা ভালো ফলাফলের জন্য দুজন শিক্ষক রেখেছেন। একজন ঘুম থেকে ওঠার পরপর তাকে প্রাইভেট পড়ান, অন্যজন পড়ান স্কুল ছুটির পর বিকেল টাইমে। দুই বেলা প্রাইভেট পড়ার কারণে সাজিদ খেলাধুলা করতে পারে না। প্রতি শুক্রবার আমার কাছে তার এ কষ্টের কথা বলতে গিয়ে প্রাইভেট শিক্ষকদের সে একজনকে সেক্টর কমান্ডার, অন্যজনকে কমান্ডার হিসেবে ব্যঙ্গ করেছে। নাসিবুর রহমান নাবিল, ১০ বছরের এ শিশুর সঙ্গে আমার ভাব গড়ে ওঠে আজ থেকে ছয় বছর আগে। অর্থাৎ প্লে-শ্রেণি থেকে। ওর শখ সাইকেল চালানো, ক্রিকেট খেলা, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি চালানো। হঠাৎ তার বাবা-মা তাকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তাকে কওমি মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছেন। দিনমান যে শিশুটি খেলা আর আনন্দের মধ্য দিয়ে পড়ালেখা করেছে, সে এখন আবাসিক প্রতিষ্ঠানে বন্দি খাঁচায়, ‘নাজায়েজ খেলাধুলা (আলেমদের ভাষায়) থেকে এখন বহুদূরে অবস্থান করছে’। এত গেল এক সাজিদ আর এক নাবিলের কথা। এ রকম হাজারো সাজিদ, নাবিল আবদ্ধ রয়েছে বাড়ি-বাড়ি, ঘরে-ঘরে। শিক্ষিত পরিবারের বাবা-মা, তার সন্তানকে খেলার মাঠে যেতে দেয় না, পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে। কেউ কেউ আবার পাড়ার দুরন্ত ছেলেটির সঙ্গে মিশে তার সন্তান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বেশি বেশি কথা বলা শিখছে; এমন অভিযোগ এনে সামাজিক শিক্ষা থেকে শিশুকে বঞ্চিত করছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সহপাঠ কার্যক্রম বিতর্ক, নাটক, নাচ-গান নেহায়েত ‘ফালতু’ কাজ এমন দুঃখজনক কথাও শুনে আসছি। এমন কথা, শুধু কতিপয় শিক্ষিত বাবা-মায়েরাই বলে আসছেন, ঠিক তা নয়। ওই শিশুর প্রাইভেট শিক্ষক, এ ধারণা শিশুর বাবা-মাকে ট্যাবলেটের মতো খাইয়ে দিচ্ছে। অথচ শরীর গঠন, মেধা বিকাশ, জড়তা কাটানো, সামাজিক বন্ধন গড়ে তুলতে একজন শিশুকে ধরাবাঁধা ছক থেকে বের করে এনে ক্রীড়া, কালচার, ভ্রমণবিষয়ক শিক্ষার পরিবেশ দেওয়া অনিবার্য, তা ওই শিক্ষক অভিভাবক জানার পরও প্রাইভেট ক্লাসের সময় ঠিক রাখা ও শিশুর তথাকথিত মঙ্গলের লক্ষ্যে বাবা-মা এমনটিও বলছেন এবং শিশুকে তেমনটি করাতে বাধ্য করছেন। শিশুর উন্নয়ন বা মঙ্গল চাপিয়ে দেওয়া কাজে হয় না। শিশুর ইতিবাচক ইচ্ছা পূরণের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশু-শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে অনেকেই শিক্ষকের কাছে প্রশ্ন করার সুযোগই পায় না। প্রশ্ন করলেই নাকি তারা বেয়াদব বনে যায়। অথচ প্রাইভেট পড়লে এই বিশেষণ ইতিবাচক ধারা পায়। আশ্চর্য! একজন শিক্ষার্থী সার্বক্ষণিক সহযোগী হচ্ছে; তার শিক্ষক। অথচ এ কী হচ্ছে শিক্ষালয়ে! শিশুর অধিকার বাস্তবায়নের এই দূর-অবস্থা কে দূর করবে?

‘কুইনিন জ্বর সারাবে, কুইনিন সারাবে কে?’ বয়সের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার প্রকোষ্টে বন্দি আমাদের কোমলমতি শিশুরা। দুর্বোদ্ধ, বিদেশি ভাষার বইয়ের বস্তা হেফজখানা, কওমি মাদরাসা, এতিমখানা ও কিন্ডারগার্টেনের প্লে-নার্সারির শিশুদের কাঁধে। সারাক্ষণ পড়ালেখা, সুনির্ধারিত ইউনিফর্মের আবরণে শিশুর চাহিদা ঢাকা পড়ে আছে। বিচিত্র ধারার, বহু মাত্রার শিশু-শিক্ষা কতটা যুক্তিযুক্ত, শিশু উপযোগী? এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা, ভাবনা, পরিকল্পনা এখনো হয়নি। বৈষম্যহীনতা, শিশুর অংশগ্রহণের অধিকার বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি নাÑসন্দেহ আছে। বর্তমান সরকার, জাতিসংঘ শিশু সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচ্ছন্ন একটি শিশুনীতি প্রণয়ন করেছেন, যা বাস্তবায়িত হলে আমাদের শিশুরা ‘শিশু স্বর্গের ফুটন্ত মানবসম্পদ’ হিসেবে বেড়ে উঠবে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার শিশুদের শারীরিক অবয়ব এবং সুস্থ দেহ ও মনের ভাবী প্রজন্ম গঠনে আয়োজন করছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেশিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধু ও মেয়েশিশুদের জন্য বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ। চালু হওয়ার কথা মাধ্যমিক স্কুলপর্যায়ের ফুটবল টুর্নামেন্ট। খবরটি শিশুসমাজের জন্য আনন্দের বটে। তবে এখানেও চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে সরকারি, বেসরকারি রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা অংশগ্রহণ করতে পারলেও খেলতে পারছে না মাদরাসার ইবতেদায়ি, হেফজখানা, কওমি শাখা এবং কিন্ডারগার্টেন নামক প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু-শিক্ষার্থীরা। ধরে নিলাম, মাদরাসায় ধর্মীয় গোড়ামি থাকায় প্রতিষ্ঠান প্রধান, তাদের শিক্ষার্থীদের খেলায় অংশগ্রহণ করতে দিচ্ছেন না, কিন্ডারগার্টেন, উন্নত শিক্ষার নামে তথাকথিত শিক্ষা প্রদানে ব্যস্ত থাকায়, তারাও আগ্রহী নয়। কিন্তু, রাষ্ট্র পরিচালকরা বা দায়িত্বশীলরা কেন, এ ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত রাখেননি বা উন্মুক্ত করার আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণ করছেন না। তবে কি ধরে নেওয়া যায় না? এখনো আমরা ধর্মীয় অন্ধত্বে জীনের বাদশার যুগ আমরা পার করছি। জাতীয় শিশু দিবস, জাতীয় শিশু অধিকার দিবস এবং বিশ্ব শিশু দিবস ঘিরে শহরকেন্দ্রিক যে শোভাযাত্রা, প্রতিযোগিতা আলোচনা হচ্ছে, তা কেন গ্রামপ্রধান দেশের তৃণমূল পর্যায় হচ্ছে না? স্থানীয় সরকারের আওতাভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং স্কুল-কলেজ, এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো কেন এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন না? তবে কি এগুলো লোক দেখানো শিশুসেবা? একজন চেয়ারম্যান, মেম্বার কি চান না তার ইউনিয়নের শিশুরা সু-নাগরিক হয়ে গড়ে উঠুক? কোনো উন্নয়নধারার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে হলে, শহরের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে তার বিস্তার ঘটাতে হয়। পচন ধরা সমাজের শৈশব-কৈশোর এখন দুর্গন্ধে নিমজ্জিত। এখনো নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে ধর্মীয় শিক্ষার আড়ালে-আবডালে, অন্ধত্ব, কুসংস্কারে ঘিরে আছে পাড়া-মহল্লা, আধুনিকতার নেতিবাচক দিকে হাবুডুবু খাচ্ছে শিশু-কিশোররা; অচল হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রীড়া-কালচার। এই দুঃখজনক পরিবেশ থেকে জাতিকে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ উপহার দিতে হলে; শিশু অধিকার বাস্তবায়ন অনিবার্য। এ ক্ষেত্রে শুধু সনদ, নীতি, আইন, সরকার এবং দাতাগোষ্ঠীর দ্বারাই তা সম্ভব নয়। প্রয়োজন, সরকারি নির্দেশনা, সামাজিক জাগরণ, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, স্থানীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, নজরদারি সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist