পঞ্চানন মল্লিক

  ২৪ মার্চ, ২০১৮

নিবন্ধ

আর নয় নৈতিক অবক্ষয়

নৈতিকতা যেন ফেরারি, তাই ফিকে হচ্ছে জীবনের আদর্শের রং। উদ্ভট সময়ের হাত ধরে হাঁটতে গিয়ে আমাদের সন্তানদের কেউ কেউ হারিয়ে ফেলছে মূল্যবোধ। রংহীন এক বিবর্ণ পুতুল যেন নেচে যাচ্ছে মননের চিলেকোঠায়, সঙ্গে সংযুক্ত তো রয়েছে মান্ধাতার আমল থেকে বয়ে চলা গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস। আমরা যতটা অন্ধ তার্কিক হচ্ছি, তার তুলনায় কতটা জ্ঞানবান হচ্ছি, দক্ষ হচ্ছি তার অনুসন্ধান কোথায়? সুস্থতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান কই? বিবেকহীন চাবুকে পিষে যাচ্ছে সব। তাই তো সুবাস হারানো বাসি ফুলের মতো জীবন থেকে অহরহ ঝরে যাচ্ছে নীতি ও সুস্থিতি। নীতির গোড়ায় ধোঁয়া ছড়াচ্ছে অজ্ঞতার ধূম্রজাল। জ্ঞান বাতি জ্বালানোর আদর্শের প্রহরীরা আজ দিশাহারা। অজ্ঞতার দৈত্য যেন গলা টিপে ধরছে ক্রমেই। সুস্থ জ্ঞানচর্চার সূতিকাগার সমাজ-ই আজ কলুষিত। জ্ঞানপাপির আক্রান্ত ছোবলে প্রতিনিয়ত সপে দিতে হচ্ছে আমাদের মতাদর্শ ও নৈতিকতা নীতিহীন বর্বরতার হাতে।

সাচ্চা কথা বলতে গেলে এখন আর বাহবা পাওয়া যায় না। কারণ কর্মে ফাঁকি যেন সবার কাছে আজ এক স্বতঃসিদ্ধ উপাত্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্ব-উদ্যোগী কর্মে যখন অবজ্ঞা, অসম্মান বা ফ্যাসাদের মারপ্যাঁচ তখন কে আর যাবে বাড়ির ভাত খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে? কিংকা মোষ কি এখন তাড়ানো যায়? উল্টে মোষরাই তো আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। নতুবা তাড়ানোর দলের অনেকেই এখন মোষদের অনুগত হয়ে বাকিদের বেকায়দায় ফেলছে। নিক্তির যে পাল্লায় পণ্য কম সে পাল্লা তো শূন্যে ঝুলে থাকে আর বাতাস তাকে ধাক্কা মারে। কিন্তু অপর পাশে যে নিরেট অকর্মণ্য পাথর চেপে আছে তা কি কেউ খোঁজ রাখে? এসব পাথর কোনো কিছুর মাপকাঠি হলেও তারা কি পণ্যের সমতুল্য হতে পারে? না আর কোনো কাজে লাগে? তবু সময় যত যাচ্ছে তৈলমর্দনে নিরেট পাথরের গা চকচকে হচ্ছে অথচ মূল্যবান স্বর্ণে ধরছে মরিচা। আমরা দায় ঠেকেই অপাত্রে ঘি ঢালা শিখছি। নীতি-আদর্শের পাঠশালা উঠে যাচ্ছে। শিশুর নৈতিক অবক্ষয় শুরু হচ্ছে গোড়া থেকেই। প্রতিযোগিতামুখী শিক্ষার পিছে ছুটতে গিয়ে আমরা তাকে বঞ্চিত করছি নৈতিক শিক্ষা থেকে। আগের মতো টোল, মক্তব, পাঠশালা এখন আর দেখা যায় না। নেই নৈতিক শিক্ষা গুরুর সাহচর্য। আগে এসব কিছু বেশ কিছুটা হলেও শিশুর নৈতিক জ্ঞানপিপাসা মেটাত। অন্তরে আদর্শের আলোকশিখা জ্বেলে, জীবনমুখী দিকনির্দেশনা দেখাত শিশুকে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে এসব থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। আমরা আমাদের শিশুদের বলছি, ‘ছোট আরো জোরে ছোট।’ কিন্তু কীভাবে, কোথা দিয়ে ছুটতে হবে তা না শেখালে তারা তো পরের আলুখেত, গমখেত, সরিষাখেত নষ্ট করবেই। পথ ছেড়ে বেপথে ছুটতে গেলে তাদের পাও তো রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হবে।

অর্থের পিছে ছুটতে গিয়ে আমরা নিজের সন্তানদের সময় দিতে পারছি কতটুকু? সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, তার খবর কি রাখতে পারছি সব সময়? বেড়ে ওঠাকালীন একজন শিশুকে তো প্রতিনিয়ত অনেক কিছু শিখতে হয়, জানতে হয়। আমরা যদি সময় না দিই তাহলে আমাদের সন্তানরা শিখবে কার কাছে? বলতে পারেন স্কুলশিক্ষক, প্রাইভেটশিক্ষক, তারা তো রয়েছেন। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন প্রতিযোগিতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে আমাদের সন্তানরা এখন কী করে জীবনে আদর্শ মানুষ হতে হবে সেটা শিখছে না। রেসের মাঠের ঘোড়া হয়ে কী করে সবার আগে দড়ি ছুঁতে হবে সেদিকে ছুটছে? অবশ্য সব শিক্ষকই যে পেশাদারি দায়িত্বের বাইরে কিছু করেন না তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আপনার শিশু যদি আপনার সৎ পরামর্শ, আদর্শ বা নৈতিকতার সান্নিদ্ধ না পায়, তাহলে শিক্ষকদের তারা কতখানি অনুসরণ করবে? দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? সন্তানদের প্রতি আমাদের স্নেহ-মমতার ঘাটতি হলে সন্তানরাও মাতা-পিতা, শিক্ষক, গুরুজন ও সমাজের অন্যদের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হবে। তা ছাড়া একজন শিশু তো সব সময় শিক্ষকদের কাছে থাকে না। পরিবারই তো শিশুর আসল শিক্ষালয়। তা ছাড়া পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, খেলার সাথি, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদিও শিশুর কৌতূহলী মনে বেশ প্রভাব ফেলে। তাই পচনটা যেকোনো এক জায়গা থেকেই ধরতে পারে। আর এর সব খবর কি শিক্ষকদের পক্ষে রাখা সম্ভব? যেভাবেই হোক শিশুদের নৈতিক শিক্ষার দায় তাই মা-বাবা বা অভিভাবকরা এড়াতে পারেন না। আমরা ঘাটতিটা কোথায় তা না দেখে শুধু পরস্পরকে দোষারোপ করে যাচ্ছি।

আমাদের সন্তানরা দৈনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেছনে যতটুকু সময়, শ্রম দিচ্ছে তার শতকরা ১০ ভাগও কি নৈতিক শিক্ষার পেছনে দিতে পারছে? তা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেছনে আমরা যতখানি জোর দিচ্ছি, নৈতিক শিক্ষার পেছনে কি ততখানি জোর দিচ্ছি বা সময় ও অর্থব্যয় করছি? আবার কতটুকুই বা নজর রাখছি এদিকে? বড়জোর পাঠাতে হয় তাই পাঠিয়ে দায় সারছি অনেকেই। কারণ এতে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য ভালো নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা বা সুযোগ নেই। তাই গুরুত্ব কম। আবার যার কাছে নৈতিক শিক্ষা নিতে পাঠাচ্ছি, তার মধ্যেও যে কতখানি গুণ বা যোগ্যতা আছে তাও কি যাচাই করে দেখছি? যদি সরিষার মধ্যে ভূত থাকে, তবে তো উল্টো রেজাল্ট হবে। শিশুদের মগজে উল্টা-পাল্টা ঢুকিয়ে দিলেও তো আরেক বিপদ। কারণ শিশু অবস্থায় মানুণের মন থাকে কাদার মতো নরম। তখন তাকে যা শেখানো হয়, তাই তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে। এ অবস্থায় ভুল কিছু শেখালে পরে তার বদলে সঠিক তথ্য প্রতিস্থাপনেও যথেষ্ট কষ্ট হয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কার কাছ থেকে আমাদের শিশুরা তাহলে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে সরকারই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজনে স্কুল-কলেজে সংশ্লিষ্ট পদ সৃজনসহ বিষয়ভিত্তিক যোগ্য ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। যারা অন্যান্য পাঠ্যবিষয়ের মতো শিশুর নৈতিক শিক্ষা বিকাশে ও সুন্দর চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও আরো সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন সন্তানই পরিবার, সমাজ তথা দেশের সার্বিক মঙ্গলে অবদান রাখতে পারবে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist