মীর আব্দুল আলীম

  ১৬ মার্চ, ২০১৮

মতামত

বিমান চলাচলে অশনিসংকেত

বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান চলাচল ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটেছে। ইতিবাচক কথা হলো, গত কয়েক বছরে আমাদের জাতীয় পতাকাবাহী বিমানের বহর বড় হয়েছে। বিদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান। দেশের অভ্যন্তরে ও আশপাশের দেশগুলোতে যাত্রী পরিবহনে যুক্ত এসব বিমান। এর মধ্যে ইউএস-বাংলা অন্যতম। ইউএস-বাংলার যাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। মাত্র চার বছরে এই বিমান কোম্পানি দেশের সেরা বিমানের মর্যাদা পায়। আন্তর্জাতিক রুটেও যথেষ্ট সুনাম ইউএস-বাংলার। তারা এগিয়ে যাচ্ছিল দুর্বার গতিতে। দেশ ছাড়িয়ে ভারত, সিঙ্গাপুর, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মাসকাটে দক্ষতার সঙ্গে দেশীয় এই বিমান সংস্থাটি বিমান পরিচালনা করে সুনাম পায়। ইউএস-বাংলা দুঃসাধ্য একটি কাজ করেতে যাচ্ছে চলতি বছর। বাংলাদেশ বিমানও যেখানে চীন দেশে ফ্লাইট দিতে ব্যর্থ, সেখানে আন্তর্জাতিক লবিংয়ের মাধ্যমে ইউএস বাংলা দু-এক মাসের মধ্যে চীনে তাদের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। হাজীদের উদ্দেশ্যে জেদ্দায় তাদের ফ্লাইট শুরু হচ্ছে চলতি বছরই। অল্প সময়ে ইউএস-বাংলার এত সাফল্যে ঈর্ষণীয় অনেকেই। নানা কারণেই আন্তর্জাতির অনেক বিমান সংস্থা রোশানলে আছে ইউএস-বাংলা। বাংলাদেশের এক বেসরকারি বিমান সংস্থার দাপটের সঙ্গে অনেক দেশি-বিদেশি বিমান সংস্থাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আসাতে তারা ঈর্ষণীয় হয়।

এ দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ তদন্ত সাপেক্ষ। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের ভুল বার্তার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে আজকের (১৫ মার্চ) পত্র-পত্রিকায়ও সংবাদ ছেপেছে। নেপাল বিমানবন্দরে টাওয়ার থেকে ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তি তৈরির বিষয়টি এখন অনেকটাই স্পষ্ট। পাইলটের অডিও থেকে তা নিশ্চিৎ হওয়া যায়। টাওয়ার থেকে বলা হয়, ‘বাংলাস্টার টু ওয়ান ওয়ান। রানওয়ের কোন প্রান্তে নামতে চান। জিরো টু অথবা টু জিরো।’ উত্তরে পাইলট বলেন, ‘আমরা টু জিরোয় (উত্তর রানওয়ে) নামতে চাই।’ কথোপকথনের ১ মিনিট ২২ সেকেন্ড পর টাওয়ার থেকে বলা হয় ‘ঠিক আছে, রানওয়ে টু জিরো ক্লিয়ার।’ বাতাসের গতি তখন ঘণ্টায় ২৭০ ডিগ্রি ৬ নটিক্যাল মাইল। টাওয়ারের উত্তরে পাইলট বলেন, ‘জানলাম (কপিড)। ল্যান্ডিংয়ের জন্য ক্লিয়ার।’ ঠিক সে মুহূর্তে টাওয়ার থেকে অবার বলা হয়, ‘বাংলাস্টার আপনারা কি রানওয়ে দেখতে

পাচ্ছেন, নিশ্চিত করুন।’ পাইলট তখন জানান, ‘নেগেটিভ স্যার।’ টাওয়ার থেকে তখন বলা হয়, ‘বাংলাস্টার টু ওয়ান ওয়ান ডানে ঘুরুন। এখন রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন না?’ পাইলট তখন বলেন, হ্যাঁ, পাচ্ছি। ল্যান্ডিংয়ের জন্য অনুমতি চাচ্ছি। (রিকোয়েস্টিং ক্লিয়ার টু ল্যান্ড স্যার)।’ টাওয়ার থেকে তখন বলা হয়, ‘হ্যাঁ, অনুমতি দেওয়া হলো।’ কিন্তু উত্তর অংশে নামার অনুমতি পাওয়ার ঠিক এক মিনিটের মাথায়ই পাইলট আবার দক্ষিণ (জিরো টু) রানওয়েতে অবতরণ করতে যাচ্ছেন বলে জানান। টাওয়ারও অনুমোদন দেয়। এ সময়ই আবার পাইলট টাওয়ারকে জিজ্ঞেস করলেন, তাদের অবতরণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কি না? জিরো টুতে অনুমোদন দেওয়ার ঠিক ৫০ সেকেন্ড পরে টাওয়ার চিৎকার করে ডানদিকে ঘুরতে বলে। এর কিছুক্ষণ পরেই রানওয়ে বন্ধের ঘোষণা আসে। কিন্তু ততক্ষণে ফ্লাইটটি রানওয়ে ছুঁয়ে ফেলে। আর টাওয়ারের নির্দেশে ঘুরতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় উড়োজাহাজটি।

নেপালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সে সময় দায়িত্বে থাকা ছয় কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এটা প্রাথমিক শাস্তিরই অংশ বলা যায়। তাদের ভুলভ্রন্তি ধরা না পড়লে বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ হয়তো তা করতেন না। ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৫১ জন মারা গেছেন। আহত ২০ জন। এর মধ্যে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এ ক্ষতির দায় অবশ্যই কাউকে না কাইকে নিতে হবে। আমরা এ দুর্ঘটনার সঠিক এবং দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাই। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যাপারগুলো চিহ্নিত করার জন্য যে তদন্ত কমিটি হয়েছে, আমরা আশা করব, ওই কমিটি যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করবেন। তবে ফ্লাইট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের দিক থেকে কোনো ভুলভ্রান্তি ছিল না বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। বিমানটি ক্যাপ্টেনের কোনো প্রবলেম এখন খুঁজে পায়নি কেউ।

ইউএস-বাংলার ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ মডেলের বিমানে তিনি এক হাজার ৭০০ ঘণ্টা ফ্লাই করেছেন। বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশনে পাঁচ হাজার ঘণ্টার বেশি কাজ করেছেন। কাঠমান্ডু এয়ারফিল্ডে শতাধিক ল্যান্ডিং ওনার আছে। এয়ারফিল্ড, এয়ারক্রাফট ওনার জন্য নতুন কিছু না। নিঃসন্দেহে তিনি একজন দক্ষ বিমান চালক। বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান চলাচল ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটেছে, এটি ইতিবাচক হিসাবেই সবাইকে দেখতে হবে। এটি দেশের জন্য অর্জন বটে। অনেক গণমাধ্যম ন্যাক্কারজনকভাবে বলছেন বিমানটি পুরাতন। বৈমানিক অনভিজ্ঞ ছিল। তবে প্রথম শ্রেণির এক পত্রিকা বলছে, ‘ইউএস-বাংলা বোম্বার্ড ইয়ার্ডেও যে ৮ কিউ-৪০০ উড়োজাহাজ ব্যবহার করেছে। সেটি বেশ উন্নতমানের। ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ মডেলের বিমানটি পুরাতন কিংবা ওল্ড মডেলের বলার কোনো সুযোগ নেই। দুর্ঘটনা কবলিত বিমানের পাইলটের দক্ষতা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।

ত্রিভুবন বিমানবন্দর বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর একটি। এ বিমানবন্দরে এর আগেও বেশ কয়েকবার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। পাহাড় ঘেরা এই বিমানবন্দরটি কাঠমান্ডু উপত্যকায় এবং শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। একের পর এক বিমান দুর্ঘটনার কারণে এই বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়। নেপালের বিমান বন্দরে কর্মরতদের দক্ষতা নিয়ে এর আগে অনেক প্রশ্ন ওঠে। নেপাল থেকে বিবিসির সংবাদদাতা বলছেন, বিমানবন্দরটিতে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো বিমান অবতরণের পর থেকে এ পর্যন্ত ৭০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বলা হচ্ছে, এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বিমানের পাশাপাশি সেখানে হেলিকপ্টারও বিধ্বস্ত হয়েছে অনেক। উইকিপিডিয়া বলছে, নিয়মিত বিমান চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকেই এখানে একের পর এক বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ১৯৯২ সালে থাই এয়ারওয়েজের একটি এয়াবাস অবতরণ করার জন্যে বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় একটি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়। এতে ১১৩ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে হয় আরো একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা। পিআইএর বিমানটি বিধ্বস্ত হলে বিমানের ভেতরে থাকা ১৬৭ জনের সবাই প্রাণ হারান। ১৯৯৫ সালে রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইনসের একটি বিমান বেষ্টনী ভেঙে মাঠের ভেতরে ঢুকে যায়। তাতে দুজন নিহত হন। লুফথানসার একটি বিমান এয়ারপোর্ট থেকে উড়াল শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়। তাতে পাঁচজন নিহত হন। এটি ঘটেছিল ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে। ওই একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নেকন এয়ারের একটি বিমান ত্রিভুবন বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় একটি টাওয়ারের সাথে সংঘর্ষে কাঠমান্ডু থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি অরণ্যে বিধ্বস্ত হয়। এতে ১০ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রুর সবাই মারা যান । ২০১১ সালে বুদ্ধ এয়ারের একটি বিমান বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় দুর্ঘটনায় ২০ জন আরোহীর প্রাণ হারান। ২০১২ সালে সিতা এয়ারের একটি বিমান উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয়। এতে ১৯ জন আরোহীর সবাই মারা যান। ২০১৫ সালে তুর্কী এয়াারলাইনসের একটি বিমান নামতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। ৩০ মিনিট ধরে এটি বিমানবন্দরের ওপর উড়তে থাকে। দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় নামতে পারলেও সেটি রানওয়ে থেকে ছিটকে মাঠের ঘাসের ওপর চলে যায়। ওইসময় ২২৭ জন যাত্রী আহত হন। ২০১৭ সালের মে মাসে সামিট এয়ারলাইনসের একটি বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়। সর্বশেষ দুর্ঘটনার শিকার হলো ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমানটি।

প্রশ্ন উঠেছে, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের একের পর এক বিমান দুর্ঘটনায় শতশত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে তাতে নেপাল সরকার কী করছেন? বিমানবন্দরটি নিরাপদ করতে তারা কেন পারছেন না? নাকি নিরাপদ করছে না। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, দায়িত্বহীন বিমানবন্দরে বিমান পরিচালনা কতটা যৌক্তিক?

বাংলাদেশের বিমান ইউএস-বাংলা বিধ্বস্ত হওয়ার পর নেপালে বিমান চলাচলে নিরাপত্তার দুর্বলতার বিষয়টি আবারও চোখের সামনে চলে এলো। নেপালে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে তাদের সমালোচনা হয়েছে। তাতেও তারা শতর্ক হয়নি কখনো। তাই এবারও যা হবার তাই হলো। আমরা এ জাতীয় বিমান দুর্ঘটনার পরিসমাপ্তি চাই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist