মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ০৪ মার্চ, ২০১৮

সিরিয়া

ডুকরে ডুকরে কাঁদে মানবতা

চারদিকে হাহাকার। চিৎকার আর ক্ষোভ দৃশ্যমান। রক্তাক্ত দেহগুলো পড়ে আছে রাস্তার চারপাশে। ছোট্ট শিশুটির কান্নার আওয়াজে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসছে। রক্তে রঞ্জিত বোনটি আধো পায়ে সামনে এগোচ্ছে কিন্তু পরক্ষণে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। বাচ্চাগুলো ভয়ে আর আতঙ্কে মাকে ঝাপটে ধরছে প্রতিনিয়ত। অদূরে কাতরাচ্ছে কয়েকটি শিশু। বাবা কাছে গিয়ে দেখেন, তার আদুরের প্রিয় সন্তান আর নেই। তখন চিৎকারের মাত্রা দ্বিগুণ হয়। মা কাঁদতে ভুলে যান ঠিক এই সময়টায়। এদিকে ভাই বোনকে হারিয়ে নির্বাক, বোন ভায়ের লাশ দেখে চিৎকার।

ড্রেনগুলোয় এখন পানির বদলে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তাজা রক্তে রাস্তার অলিগলি ভেসে গেছে সেই কবে। তাদের নেই কোনো বাসস্থান, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুনও তারা কেড়ে নিয়েছে। অবলা নারীরা রাস্তাঘাট কিংবা ধ্বংসস্তূপের কোনো এক কোণে লুকিয়ে থাকেন খুব কষ্ট করে।

বলছিলাম, সিরিয়ার পূর্ব ঘৌতা শহরের কথা।

ঘৌতা শহরের প্রতিটি মহল্লা, প্রতিটি গলি আর বাড়ির চিত্র এখন এমনই। খুব কম বাড়িই এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শিশু, বৃদ্ধ, নারীদের কেউ হাত-পা হারিয়েছে, কেউ সারা গায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে অস্থায়ী হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আর যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে মৃত্যু ও বোমার স্পিøন্টার থেকে তারা ধ্বংসস্তূপে খুঁজছে স্বজনের লাশ, কেউ বা লাশ নিয়ে যাচ্ছে কবরস্থানে। ১০৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পূর্ব ঘৌতা এলাকাটিতে প্রায় চার লাখ লোকের বাস। বাসিন্দাদের অর্ধেকের বেশির বয়স ১৮ বছরের নিচে, অর্থাৎ শিশু-কিশোর। রাজধানী দামেস্ক থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যের এই এলাকাটি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ২০১৩ সাল থেকে এলাকাটি অবরোধ করে রেখেছে বাশার আল আসাদের সরকারি বাহিনী। এবার এলাকাটির দখল নেওয়ার জন্য সিরীয় সেনাবাহিনী একযোগে হামলা শুরু করেছে। তাদের সরাসরি সহযোগিতা করছে রাশিয়া ও ইরান। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নিরপরাধ বেসামরিক লোকদের। গত দশ দিনে নিহত হয়েছে পাঁচশোর বেশি লোক। এটি শুধু বিভিন্ন সংস্থার হিসাব। ধারণা করা হচ্ছে, আরো অনেক মৃত্যুর হিসাব নথিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলোর নিচে চাপা পড়ে আছে অনেক লাশ। কিংবা ভূগর্ভের বাংকারে আশ্রয় নেওয়া লোকরা হয়তো বিষাক্ত গ্যাস হামলায় নীরবে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, কেউ তাদের খোঁজ পায়নি। কোনো দেশের সরকার নিজ দেশের জনগণকে মারার জন্য ভিনদেশি বাহিনী ডেকে আনে। এমন নজির বিশ্বে সম্ভবত এই প্রথম। রাশিয়া তাদের নতুন নতুন সব মারণাস্ত্রের কার্যকারিতা প্রয়োগের জন্য বেছে নিয়েছে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রকে। তাদের সর্বাধুনিক স্টিলথ প্রযুক্তির ফাইটার প্লেন সু-৫৭ ইতোমধ্যেই আনা হয়েছে সিরিয়ায়। এই বিমানটি রাশিয়ার সর্বাধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তির একটি পণ্য, যা এই প্রথম সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আগে তারা কয়েক ধরনের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে সিরিয়ার নিরীহ জনগণের ওপর। বিশ্লেষকরা বলছেন, শূন্য মরুভূমিতে যুদ্ধাস্ত্র পরীক্ষার পরিবর্তে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে তা ব্যবহার করছে রাশিয়া। সিরিয়ার নিরীহ জনগণের মৃত্যুর হিসাবের চেয়েও তাদের কাছে অস্ত্র পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

সিরিয়ার যুদ্ধে আসাদ সরকারের আরেকটি নির্মম কৌশল হচ্ছে অবরোধ। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো তারা বছরের পর বছর অবরোধ করে রেখে সেখানে খাদ্য, পানি, ত্রাণ এমনকি ওষুধ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে না খেয়ে মারা যায় অনেক লোক, শিশুরা ভোগে পুষ্টিহীনতায়। রুগ্ণ-জীর্ণ শরীরের কোনো শিশুর ছবি হয়তো ভাইরাল হয়, কিন্তু কদিন পর বিশ্ব ভুলে যায় তাদের কথা। ফলে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে সরকারের এই হত্যাযজ্ঞ। এর আগে আলেপ্পোর মাদায়া, ফোয়া ও ফারিয়া শহরের সরকারি অবরোধের চিত্র ছিল ভয়াবহ। সেখানে খাবারের অভাবে মানুষ গাছের ডাল-পাতা এমনকি পোষা বিড়ালের মাংস খেয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে মাদায়ার অবস্থা ছিল ভয়াবহ, শহরটিতে ২০১৬ সালের অবরোধে না খেয়ে মারা গেছে কয়েক শ মানুষ। প্রায়ই রাস্তায় পড়ে থাকত অনাহারি মানুষের লাশ। পূর্ব ঘৌতায়ও একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে আসাদ সরকার। ২০১৩ সাল থেকে অবরুদ্ধ থাকা এলাকাটিতে এখন খাদ্যদ্রব্যের চরম সংকট চলছে। ২৮ বছর বয়সী আছিয়া বিবিসিকে জানিয়েছেন, কাজের সন্ধানে যাওয়ার সময় তার স্বামী নিহত হয়েছেন বিমান হামলায়। তিন সন্তান নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন একটি ভূগর্ভের আশ্রয়কেন্দ্রে। একটি সন্তান অসুস্থ, তার জন্য ওষুধ ও খাবার কিছুই জোগান দিতে পারছেন না। প্রথম দিকে অবরোধ সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা গোপন পথে কিছু খাবার আমদানি করতেন; কিন্তু বিমান হামলা বৃদ্ধির কারণে এই পথও বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো দোকানে একটি রুটি পাওয়া গেলে তা বিক্রি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ২২ গুণ বেশি দামে।

এ মার্চ মাসেই আট বছরে পড়বে সিরিয়ার যুদ্ধ। ২০১১ সালে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু করেছিল সাধারণ জনতা, তার দায় এখন তাদের শোধ করতে হচ্ছে জীবন দিয়ে। আর এই যুদ্ধে নিষ্ঠুরতার যত প্রক্রিয়া আছে তার সবই প্রয়োগ করছে সরকার। প্রায়ই বিষাক্ত কোরিন গ্যাস ছোড়া হচ্ছে আবাসিক এলাকাগুলোয়। কোনো জখম, রক্তপাত ছাড়াই নীরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে মানুষ। আহত লোকদের চিকিৎসা দেওয়ার পথও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। নির্বিচারে বোমা হামলা চালানো হচ্ছে হাসপাতালগুলোয়। গত এক মাসে ২৯টি হাসপাতাল ও অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্রে বোমা ফেলা হয়েছে বিমান থেকে। মারা গেছে অনেক রোগী। হাসপাতালের সামনে পার্কিং করে রাখা অ্যাম্বুলেন্স ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে বোমায়। গত ১০ দিনে ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স ধ্বংস হয়েছে রাশিয়ার বিমান হামলায়। মারা গেছে অন্তত ১০ জন ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মী। নিহত হয়েছে শিশুসহ ৫৬০ জন।

শহরটির পুনরুদ্ধারে আসাদ বাহিনী গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে হামলা চালিয়ে আসছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নয় দিনের যুদ্ধে নিহত হয়েছে দুই সহস্রাধিক মানুষ। অবরুদ্ধ ওই এলাকায় থাকা এক সিরীয় সাংবাদিক মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিডলইস্ট মনিটরকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে, বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় ঘৌতায় অভিযানে বেশ অগ্রসর হয়েছে সরকারদলীয় ও তাদের মিত্র মিলিশিয়া বাহিনী। রাশিয়ার যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা সত্ত্বেও বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটির পূর্বদিকের হাউয়েস আল-দাওয়াহিরা অঞ্চলে বেশ অগ্রসর হয়েছে সরকারি বাহিনী। তবে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সিরিয়া সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীপক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার মধ্যেও ঘৌতায় বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত বাহিনী। এর আগে মেডিসিন স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স ১০ দিনে আসাদ বাহিনীর হামলায় ৭০০-এরও বেশি মানুষ নিহতের খবর পাওয়ার কথা জানিয়েছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলীয় ঘৌতায় প্রায় চার লাখ মানুষের বসবাস। আর এ অঞ্চলটিই দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অন্যতম টার্গেট।

রাশিয়া ও ইরানের সামরিক সহযোগিতায় এরই মধ্যে বহু অঞ্চল বিদ্রোহীদের দখল থেকে নিজের আয়ত্তে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আসাদ। দীর্ঘ সাত বছর ঘৌতায় সরকার ও বিদ্রোহী দলের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এর মধ্যে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলটির ওপর সিরীয় সরকার ও তাদের মিত্র দলগুলো ভারী বোমাবর্ষণ শুরু করে। মানবাধিকার সংস্থাসহ স্থানীয় উদ্ধারকর্মীদের তথ্যানুযায়ী, এ হামলায় হাজার খানেক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। ক্রমেই ইতিহাসের সব বর্বরতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাশার আল আসাদের এ নিষ্ঠুরতা।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist