ইয়াসমীন রীমা
জাঙ্ক ফুড
শিশু স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি
স্কুলশিক্ষিকা নাসরিন আক্তার তার একমাত্র পুত্রসন্তান আসফির নাওয়া-খাওয়ার প্রতি যতটা না যতœবান, তার চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখেন। সামান্য কিছু হলেই তিনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তিন দিন ধরে আসফির পেটব্যথা ও থেকে থেকে বমির কারণ খুঁজতে ডাক্তারের দ্বারস্থ হয়ে জানতে পারলেন তার ফুড পয়োজনিং হয়েছে। কিসের এবং কেমন খাবার থেকে তা হলো ডাক্তার যদিও তা বলেননি। তবে আসফির কথানুযায়ী বোঝা গেল, সে কয়েক দিন ধরে স্কুলের সামনের দোকান থেকে প্যাকেটকৃত কখনো ডালভাজা, কখনো বাদামভাজা আবার কখনো আচার কিনে খেয়েছে। যার কারণে আসফির পেটে গ্যাস জমা হয়ে স্টমাকে গোলযোগ দেখা দিয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আসফির বর্তমান বয়স আট। প্যাকেটকৃত খাদ্যদ্রব্যের প্রতি তার মোহ আছে বেশ, তবে এর কুফল সম্পর্কে মোটেই ধারণা নেই তার। আসফির বাবা-মা সন্তানের এমন অসুস্থতায় যেমন চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি অস্থির কী করে এসব প্যাকেটকৃত খাদ্যদ্রব্য বিশেষ করে বাচ্চাদের নাগাল থেকে দূরে রাখা যায়।
আসফির মতো অসুস্থতার ঘটনা শুধু কুমিল্লা জেলার একটি শহরে নয়। সারা বাংলাদেশের প্রতিটি শহর এবং গ্রামের শিশুরা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে ইত্যাদি সব তৈরি খাবারের প্রতি এবং তা খেয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন জটিল রোগে। কারণ শিশুদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কম। এসব খাওয়াতে তাদেরই রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। প্রত্যেক স্কুলের সামনে বসা ফেরিওয়ালা কিংবা দোকান থেকে প্রতিদিন একাধিবার চকলেট, মালাই বরফ, আইসক্রিম, চাটনি ও বোতলজাত জুস কিনে খায়। শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এসব খাবারের সঙ্গে মেশানো হয় রাসায়নিক রং এবং সুগন্ধি, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে এসবের প্রতি তাদের আকর্ষণ খুবই বেশি। তা ছাড়া গ্রীষ্মের গরমে ঠা-াপানিতে ট্যাং গুলে কোমলপানীয় কার অপছন্দের! শিশুদের বেশি প্রিয় ট্যাং। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অনেক মায়ের কাছে বায়না ধরে এক গ্লাস ট্যাং বা এক বোতল জুস। অথচ মায়েরা জানেন না তাদের শিশুদের ট্যাং বা জুসের নামে বিষপান করাচ্ছেন। কারণ ট্যাং, জুস অথবা ফ্রুট জুসের নামে বোতলজাত কিছু পানীয় বাজারে সহজলভ্য হলেও প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে ডাই-হাইড্রো ক্লোরিন এবং স্যাক সুইটের সঙ্গে রঙিন পানির বিষাক্ত মিশ্রণ, যা পান করে শিশুরা জটিল থেকে জটিলতর রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তা ছাড়া টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলগুলোয় বিভিন্ন জুসের চটকদার বিজ্ঞাপনে শিশুরাই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বাজারজাতকৃত ৯৮.৩০ ভাগ জুসে ফলের রস বলে কিছুই থাকে না। ঢাকার মহাখালীর আইসিডিডিআরবির ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে এসব জুসে কোনো ফলের রস বিন্দুমাত্র নেই। আছে বিষাক্ত রং, যা পানে কিডনি, পেটের পীড়া এমনকি ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
এ ব্যাপারে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এইচ এম হায়দার বলেছেন, ‘চকলেট, চুইংগাম, চাটনি, জিলাপি ও কনফেকশনারি তৈরি খাবারে মিশ্রণ করা হয় হাইড্রোজ অ্যাসিড, সোডিয়াম, স্যাকারিন ও পারফিউমার জাতীয় রাসায়নিক। এগুলোর প্রতিটিই কম-বেশি বিষাক্ত। তা ছাড়া মিশ্রণটি দীর্ঘদিন রেখে দিলে আরো মারাত্মক বিষ সৃষ্টি হতে পারে।’
শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য আয়োডিনযুক্ত লবণে রান্না করা খাবারের প্রয়োজনীয়তার কথা থাকলেও বাজারে ৯৩ ভাগ কোম্পানির লবণে আয়োডিনের কোনো বালাই নেই। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার (বিসিক) হিসাব অনুযায়ী দেশে ২৭৬টি কোম্পানি আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদন করছে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি হচ্ছে ২৬৫টি কোম্পানির লবণে আয়োডিন নেই। অধিকন্তু কল-কারখানায় ব্যবহৃত তেল-মবিল রিফাইন করে সয়াবিন তেল প্রস্তুত করা হচ্ছে। ময়লা, দুর্গন্ধময় নোংরা পরিবেশে অপরিশোধিত সাপ্লাইয়ের পানি বোতলজাত করে মিনারেল ওয়াটার হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই সয়াবিন তেল খাওয়ালে শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেলের রান্না ও মিনারেল ওয়াটার নামে পানের অযোগ্য পানি পান করে শিশুরা জন্ডিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরাসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নুডলস, পাউরুটি, বিস্কুট শিশুদের প্রিয় খাবারের তালিকায় অগ্রে। কিন্তু এসব খাদ্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে এবং এসব খাদ্যসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বস্ত্রকলের ডাই ও এক ধরনের রং। এ ব্যাপারে ঢাকা সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার জাহিদুজ্জামান বলেছেন, ‘শিশুদের আরো প্রিয় মিষ্টি ঘিয়ে ভাজা সেমাইয়ের নামে এসব তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত ডাই ও কেমিক্যাল, যা শিশুদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যহানিকর। যে রং ও সুগন্ধির জন্য যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, তার কোনোটিই মানুষ দেহের জন্য উপযোগী নয়। জিংক অক্সাইড ও হাউড্রোজের মতো রাসায়নিকের মাত্রা কম হলেও শিশুদের কিডনি, ক্যানসার, লিভার, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ জটিল রোগ হওয়ার আশঙ্কা পুরোভাগ। তা ছাড়া শিশুর বদহজম, ডায়রিয়া, আমাশয়, কৃমি, ক্ষুধামন্দাসহ টিউমারের মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে। হাইড্রোক্লোরিন, স্যাকারিন ও সোডিয়াম বাড ক্যানসার ও মস্তিষ্কের টিউমারের মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি শিশুকে সহজে প্রতিবন্ধী করে দিতে পারে।
কুমিল্লা জেলার শিল্প-কারখানা ও ফ্যাক্টরি পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জেলায় মোট ১৬টি উপজেলায় মাত্র ৯০টি খাবার তৈরির ফ্যাক্টরির নিবন্ধন আছে। অথচ জেলায় খাবার তৈরির ফ্যাক্টরির সংখ্যা তিন হাজারেরও অধিক। এসব ফ্যাক্টরির তৈরি খাবারের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসআিই) সূত্র থেকে জানা যায়, জেলায় মাত্র ১৪টি ফ্যাক্টরির ছাড়পত্র আছে। অর্থাৎ বাকি তিন হাজারের মতো প্রতিষ্ঠানের খাবারের মান যাচাই করার সুযোগ নেই। অতিরিক্ত ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা শিল্পকর। অধিকাংশ খাবারের মোড়কে বিএসটিআইয়ের সিল নেই। আর যেগুলো নজরে পড়ে তা নকল।
কিছুদিন আগে বর্তমান সরকারের পরিচালিত ভেজালবিরোধী অভিযানে দেশে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। তা ছাড়া খাদ্যে ভেজাল ঠেকানোর জন্য কঠোর আইন করেছে সরকার। যে আইনে তিন বছরের কারাদ- ও সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এর পরও নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বাজারজাত বন্ধে সরকারকে যেমন সর্বদায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, তেমনি ক্রেতা-ভোক্তাদেরও হতে হবে সচেতন।
শিশুরোগ সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (আইএমসিআই) প্রত্যেকের পারিবারিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছে। নিয়মিত সুষম খাদ্যাভ্যাস ও সুষ্ঠু পরিচর্যা শিশুর সুস্থ শরীর গঠনে সহায়তা করে এবং একই সঙ্গে শিশুকে রোগাক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে, তাই প্রতিটি পরিবারের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা প্রয়োজন। আইএমসিআই এ কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে প্রতিটি বাবা-মাকে সচেতন করে তোলে। যাতে সন্তানের রোগ প্রতিরোগ তার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ পুষ্টির সঙ্গে জড়িত। শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করতে হবে। তাই একটি বলিষ্ঠ জাতি গঠনের লক্ষ্যে শিশুর যতেœ আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেষ্ট। চার্লস ডিকেন্স বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে প্রতিটি নবজাতকের অবয়ব পূর্ববর্তী শিশুর জন্মের চেয়ে আলাদা এবং সুন্দর।’ শিশু যে কেবল আনন্দের বিষয় তা নয়, তার মধ্যেই বেঁচে থাকে পরবর্তী প্রজন্ম। সে ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, এ থেকে কোনো অবস্থায়ই রোগটি যাতে জটিল আকার ধারণ করতে না পারে। বর্জন করতে হবে বাজারের তৈরি খাবার। শিশুদের বোঝাতে হবে এসব খাবার আসলে অখাদ্য। শিশুদের বাবা-মায়েরা যদি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হন, তবেই প্রতিরোধ সম্ভব হয়ে উঠবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"