ইয়াসমীন রীমা

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মতামত

নারী শ্রমিকের বাঁচা-মরা

তিন দিন ধরে মোমেনার বাড়িতে চুলায় আগুন ধরাতে দেয়নি তার স্বামী ডেকোরেটর দোকানের সহকারী রফিকউল্লাহ মিয়া। চুলায় আগুন না জ্বললেও মোমেনার ঘরে জ্বলছে বিবাদের আগুন। যে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে বিবাহিত জীবনের তিন বছরের সব সুখস্মৃতি-অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, ভালোলাগা হাসি-খুশির প্রহর। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আগামী দিনের সাজানো স্বপ্ন এবং আশা। দরিদ্র ঘরের মেয়ে মোমেনা ক্লাস ফোর পর্যন্ত স্কুলে যাওয়া-আসা করেছিল। কিন্তু দরিদ্রতা তাকে আর স্কুলের আঙিনায় যেতে দেয়নি। কিশোরী বয়সের আভা অবয়বে প্রকাশিত হওয়ার আগেই মাত্র ষোলো বছর বয়সে, চাপকল মিস্ত্রি বাবা আতর আলী অনেক শখ করে পাশের গুনাইঘর গ্রামের জসিম খলিফার বড় ছেলে রফিকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মেয়ে খেয়ে-পরে সুখেই থাকবে। বিয়ের বছর রফিকের সঙ্গে মোমেনার যাপিত-জীবন কাটছিল মোটামুটি ভালোই। অর্থের টানাটানি থাকলেও উপোস করতে হয়নি তাকে কোনোদিন। এরই মধ্যে সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে মোমেনা গ্রামের দু-চারজন বউ-ঝিদের পরামর্শে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার অন্দরে পাওয়ার লুম কারখানায় কাজ নেয়। এমন কাজের বিনিময়ে মজুরি খুব একটা কম নয়। মোমেনার এমন কাজে স্বামী রফিকউল্লাহ মিয়ার অসম্মতি থাকলেও পরে নিষেধ করেনি। সে-ও প্রতিদিন তাকে মিলে পৌঁছে দিত। আবার কাজ শেষে দুজনে মিলে বাড়ি ফিরত।

বিয়ের তিন বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর মোমেনার কোলজুড়ে কেউ না আসতে দেখে তার বিধবা শাশুড়ি সময়-অসময়ে তাকে জ্বালাতন করতেন। কখনো স্বামীর সামনে কখনো একা পেয়ে বকাঝকা করতেন। তা ছাড়া শাশুড়ির আকাক্সক্ষার শেষ ছিল না। কবে তার নাতি আসবে সে তাকে কোলে নিয়ে সারাগ্রাম ঘুরে বেড়াবে। আদর-যতেœ ভরিয়ে রাখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এত দিনে নাতির আগমনের কোনো সু-সংবাদ না পাওয়াতে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। ছেলেকে বলে-কয়ে কবিরাজ-তাবিজ-কবচ ইত্যাদি করিয়েছেন অনেক। কিন্তু কোনো ফল না পেয়ে ছেলেকে শত অনুরোধ করে মোমেনাকে নিয়ে শহরে ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান দিয়েছেন মোমেনার মা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘদিন পাওয়ার লুম মিলে কাজ করতে করতে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাবে তার প্রজনন ক্ষমতাটি নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তারের এমন কথায় মোমেনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সেই মুহূর্তে পাগলের মতো হয়ে ওঠে সে। তার কাজের সাথিরা তাকে সেই মুহূর্তে আশ্বস্ত করে। বাড়িতে এসে রফিকউল্লাহ মিয়া পাওয়ার লুমে কাজ করার অসম্মতির কথা তুলে তাকে রীতিমতো আক্রমণ করে বসেন। সন্তান না হওয়ার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেন। সময়মতো গ্রামের মেম্বারের মাধ্যমে তালাকনামা পাঠিয়ে দেওয়ার কথাও জানান। কী করবে এখন মোমেনা? চলে যাবে রফিকের সংসার ছেড়ে? এসব কিছুরই উত্তর খুঁজে পায় না সে।

সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষ বিজ্ঞানকে তার উন্নতির সোপান তৈরিতে কাজে সাধিত করেছে। আর সুযোগ বুঝে বিজ্ঞান ও সভ্যতার সর্বাঙ্গে ছড়িয়েছে বিষাক্ত থাবা। তাই আজ মা ও শিশু সর্বদাই পরিবেশ দূষণে জর্জরিত। সারা বিশ্বে বর্তমান সময়ে বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ও প্রসূতি মায়ের যতেœর প্রচুর উন্নতি হয়েছে। উন্নতকামী দেশগুলো সব সুযোগ নেওয়ার জন্য মরণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। গত শতাব্দীর দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, বিশ্বে পরিবেশ দূষণই হচ্ছে প্রধান বিষয়। শিল্পায়নের যুগে বিপ্লব ঘটাতে গিয়ে কল-কারখানায় বিষাক্ত রাসায়নিকদ্রব্য বা উপকরণ মার্কারি, সিসা, পারদ, রাসায়নিক জৈব, আর্সেনিক ইত্যাদি ব্যাপক ব্যবহারের ফলে আজ পরিবেশ দূষণের মাত্রা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। যেকোনো শিল্পে ব্যবহৃত রাসায়নিকদ্রব্য প্রজনন ক্ষমতার ওপর কমবেশি প্রভাব ফেলে। ফলে অন্তঃসত্ত্বা নারী যারা কারখানাতে কাজ করেন তাদের সন্তানের জন্মগত ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বেঁচে থাকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কিশোরী থেকে শুরু করে যুবতী নারীরা বিভিন্ন ধরনের মিল-কারখানায় কাজ করছে। পরিবারের দরিদ্রতা লাঘবে প্রচেষ্টায় তারা জড়িয়ে পড়ছে মিল-কারখানার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। সারা দেশে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ শ্রমিক কাজ করছে বিদ্যুৎচালিত তাঁত (পাওয়ার লুম) কারখানায়। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫ থেকে ৭ লাখ। তবে তাদের মধ্যে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীর সংখ্যাই বেশি। তাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা নারী শ্রমিক তাদের প্রতিদিনের আয়ের ওপর খাবার নির্বাহ হয়। পাওয়ার লুমে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশ, প্রচ- দাবদহে দিনের পর দিন এই নারী শ্রমিকরা কাজ করেন। বিশেষ করে বছরের পর বছর পাওয়ার লুমের ডাস্টে অবস্থান করার ফলে তাদের অনেকের প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে বন্ধ্যা হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। তা ছাড়া নানা অসুখ-ফুসফুসে ক্যানসার, কিডনি, লিভারসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গে জটিল ব্যাধি আক্রমণ করতে পারে এবং এসব ফিজিক্যাল ফ্যাক্টর মাতৃত্বের আঘাত হানে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. এ এফ এম জাফরউল্লাহ সরকারের মতে, ‘মিল-কারখানার তাপমাত্রা, কম অক্সিজেন, শব্দদূষণ ইত্যাদির জন্য দায়ী। হাই-অলটিটিউডে বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া গেলে তাতে অক্সিজেনের পরিমাণ কম, ফলে কম ওজনের শিশু জন্মায় কিংবা মায়ের গর্ভে শিশু পরিপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পায় না। তা ছাড়া তাপমাত্রা অধিক হলে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া ক্রনিক ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, হাঁপানি ও ফুসফুসে পানি জমে পরে ক্যানসারের আশঙ্কাকে ঘনীভূত করে।’

দেশের অনেক এলাকায় বিশেষ করে বিদ্যুৎচালিত তাঁত মিলের নারী শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা যায়, বিয়ের পর একজন নারীর সবচেয়ে বড় সাফল্য এবং স্বপ্ন সন্তানের মা হওয়া। কিন্তু বিয়ের পর তাদের অনেকেই সন্তান ধারণ করতে পারেননি। যার কারণে তাদের দাম্পত্যজীবন বিবাদ, নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতা সৃষ্টি করছে। তবে অনেক নারী শ্রমিক এই পরিবেশে কাজ করতে করতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধিতে ভুগছে। বেশির ভাগ নারী শ্রমিকই রোগগ্রস্ত। এমনকি তাদের সন্তানরাও রক্ষা পাচ্ছে না।

বিশ্বে কিছু দেশে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কল-কারখানা ও মিল ফ্যাক্টরিগুলোয় সব ধরনের মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করেÑএমন সব দ্রব্য ও উপকরণের ব্যবহারের সতর্কতা অবলম্বন শুরু করা হচ্ছে। দেশগুলোর মধ্যে সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং কানাডা অগ্রগামী অবস্থানে আছে। তা ছাড়া ইন্দোনেশিয়ান সরকার ইকোলোজিক্যাল গবেষণা ও কর্মসূচিতে ব্যাপক অর্থব্যয়ের মাধ্যমে এসব দূষণ ও প্রভাব বিস্তারকে ৬৫ শতাংশ সতর্ক পর্যায় নিয়ে তাদের কল-কারখানায় উৎপাদনের হার ১২ শতাংশ বাড়িয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদেরও পিছিয়ে থাকার অবকাশ নেই। অতি দ্রুত নীতিনির্ধারণী মহল মিল-ফ্যাক্টরি ও কল-কারখানায় নারী শ্রমিকদের কাজ করার বিপজ্জনক অবস্থা থেকে সতর্কতা ও সীমাবদ্ধতা স্থির করা। তা না হলে মোমেনার মতো আরো অনেক নারীর জীবনে ঘটে যাবে দুর্ঘটনা এবং বয়ে আনবে দুঃসংবাদ।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist