নিতাই চন্দ্র রায়

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

উন্নয়ন

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে কৃষি

সম্প্রতি খুলনার হাদিস পার্কে ২১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের কৃষকদের লড়াই-সংগ্রামের এবং অধিকার আদায়ের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক সমিতির ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় আট হাজার নেতাকর্মীর সমাবেশ ঘটে। লাল টুপি ও লাল পতাকায় সজ্জিত হাদিস পার্কটি অন্য রকম দৃশ্য ধারণ করে। ঐতিহাসিক ওই সম্মেলনে দেশের প্রখ্যাত কৃষক নেতাদের পাশাপাশি ভারত ও নেপালের বিশিষ্ট কৃষক নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের উদ্বোধক প্রবীণ কৃষক নেতা আবদুল আজিজ বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে কলমের খোঁচার জোরে কৃষকের জমির মালিকানা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পরে দেশ স্বাধীন হলেও ভূমি সংস্কার করা হয়নি। প্রতি বছর ৬৮ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে শিল্পায়ন হচ্ছে। কৃষকের জমি যাতে কৃষকের হাত থেকে চলে না যায়, সে জন্য জোরদার আন্দোলন দরকার।’ সমাবেশে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ১২ আনা ছিলেন কৃষক, খেতমজুর ও শ্রমিক। স্বাধীন বাংলাদেশে তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। কিন্তু এ দেশে ধনী আরো ধনী হচ্ছে, আর গরিব আরো গরিব হচ্ছে। উৎপাদন করছেন কৃষক আর লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।’ সারা দেশে সেচসুবিধা ও বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা নেই। বিএডিসিকে অকার্যকর করে রাখায় কৃষি উপকরণ নিয়ে ব্যবসা করছে বহুজাতিক কোম্পানি ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। ভেজাল সার ও বীজ ব্যবহার করে প্রতি বছর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। বন্যা, খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষক ক্ষতিপূরণ পান না। কৃষকরা তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতেও ঠকছেন, আবার তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বেচতে গিয়েও ঠকছেন। সরকার ধান কেনে না, কেনে চাল। এতে চাতালমালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হন ঠিকই। কিন্তু কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটে না। আবার কৃষক যখন মৌসুমে বাজারে ধান বেচতে যান, তখন চাল আমদানি করা হয়। এতে বাজারে ধানের দাম পড়ে যায়। তাই কৃষককে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।

যেদিন খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে কৃষক সমিতির নেতারা এসব কথা বলেন, ওই একই দিনে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দেশের কৃষি খাতের ব্যাপক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করেন। তিনি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষিপণ্য উৎপাদন ও উদ্ভাবনের জন্য বর্তমান সরকার, বিশেষজ্ঞ, গবেষক, কৃষিবিদ, কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তার মতে, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নযুদ্ধে জয়লাভের জন্য কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন অপরিহার্য। কেননা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও স্থিতিশীলতা অর্জনে কৃষির ভূমিকা আজও মুখ্য। সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈরিতা মোকাবিলা করে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ধান, গম, ভুট্টা, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে। এটি সম্ভব হয়েছে সরকারের বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে। বিশেষ করে কৃষকদের অনুকূলে সার, সেচ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাবদ ব্যাপকভিত্তিক কৃষি সহায়তার ফলে। তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, কৃষি খাতে আজ যে অভাবনীয় সাফল্য দৃশ্যমান, এর পেছনে নিরলসভাবে কাজ করছেন আমাদের কৃষিবিদরা। নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে তারা পরিবেশ উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ সব পর্যায়ে তা দ্রুত হস্তান্তর ও বিস্তারেও ভূমিকা পালন করছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি পচনশীল কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও বহুমুখীকরণে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষির উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়নে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের ২০৫০ কিংবা ২১০০ সালে দেশের প্রক্ষেপিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা ও খাদ্য নিরাপত্তাকে মাথায় রেখে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

সম্প্রতি প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নেত্রকোনা জেলায় প্রতি বছর দুই লাখ টনের মতো সবজি উৎপাদিত হয়। কিন্তু হিমাগার না থাকার কারণে উৎপাদিত এসব সবজি সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কৃষকদের বাধ্য হয়ে পানির দামে সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে অনেক কৃষক ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকে সবজি চাষের খরচও তুলতে পারছেন না। অন্যদিকে সারা বছর বাজারে সবজির পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় বাইরে থেকে সবজি আনতে হচ্ছে। ফলে ক্রেতাদের সবজি কিনতে গিয়ে বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে। শুধু নেত্রকোনায় কেন? সারা দেশেই হিমাগারের অভাবে বিপুল পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূল পচে নষ্ট হচ্ছে। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে প্রতি বছর কয়েক শ কোটি টাকার ফল উৎপাদন হয়। যেমন : আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, তরমুজ, কলা, কমলা, পেঁপে, পেয়ারা, লটকন ইত্যাদি। সেখানে প্রচুর শাকসবজিও উৎপাদিত হয়। কিন্তু সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে কোটি কোটি টাকার শাকসবজি ও ফলমূল পচে নষ্ট হচ্ছে। তাই কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য পার্বত্যাঞ্চলে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এবং হিমাগার স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া সারা দেশে যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হচ্ছে, সেখানেও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বেশি পরিমাণে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ হলে, বেশি মূল্য সংযোজন হবে এবং কৃষকও পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উৎপাদন-সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের অব্যস্থাপনার কারণে উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূলের প্রায় ৩১ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়, যা দেশের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য কিছু কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই এই অপচয় ১০ ভাগে কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য কৃষক-খামারি থেকে শুরু করে ভোক্তাপর্যায়ে খাদ্য সংরক্ষণব্যবস্থা উন্নত করার বিকল্প নেই। প্রাকৃতিক উপায়ে ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্যশস্য, শাকসবজি ও ফলমূল সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে হবে। বর্তমানে ৪০০ হিমাগার রয়েছে, যার ধারণক্ষতা মাত্র ৫০ লাখ টন। অথচ আলুসহ উৎপাদিত সবজির পরিমাণ অনেক বেশি। বাংলাদেশ হিমাগারমালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে আলুই উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি টন। অন্য এক খবরে জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে ঢাকার রিফাত এন্টারপ্রাইজ নামের একটি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান যশোরের সবজি বিশ্ববাজারে রফতানি করছে। নিরাপদ ব্যস্থাপনায় সবজি উৎপাদনের জন্য ইতোমধ্যে যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর ও চূড়ামনকাটি ইউনিয়নের ১৬১ কৃষকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারীর ভাষ্য মতে, জানুয়ারি মাসে তিনটি চালানের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাইয়ে ১৪০ টন বাঁধাকপি রফতানি করা হয়েছে। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে তাইওয়ানে আরো ৪৮ টন বাঁধাকপি রফতানি প্রক্রিয়াধীন। প্রায় কোটি টাকা মূল্যের এ বাঁধাকপি বিশ্ববাজারে রফতানি ফলে কৃষকপণ্যের ন্যায্যমূল্য পেয়ে লাভবান হচ্ছেন এবং দেশের জাতীয় অর্থনীতির ভিতও মজবুত হচ্ছে। কৃষকদের কথাÑ বিদেশে রফতানির কারণে তারা প্রতিটি ফুলকপি ১২ টাকা দামে বিক্রি করে খরচ বাদে বিঘাপ্রতি ৫০ হাজার টাকা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছেন।

এখন সবজির ভরা মৌসুম। সারা দেশের হাটবাজারে সবজির বিশাল সমারোহ। বাজারে সররাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে সবজির দাম। পুড়ছে অভাগা কৃষকের কপাল। মাত্র এক মাস আগে যে ফুলকপির দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন তার মূল্য ১০ টাকা, যে টমেটোর কেজি ছিল ৪০ টাকা, এখন তার কেজি ১০ টাকা, যে বেগুনের কেজি ছিল ৪০ টাকা এখন তা ২০ টাকা, বাজারে মুলা কেনার জন্য কোনো ক্রেতাই পাওয়া যায় না, ফলে অনেকে উৎপাদিত মুলা ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে মাটির সঙ্গেই মিশিয়ে দিচ্ছেন মনের দুঃখে। মূল্যবিপর্যয়ের কারণে উত্তরাঞ্চলে অনেক কৃষক আলু তোলাই বন্ধ করে রেখেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বাইশমৌজা বাজারে নিয়ে আসা টমেটোচাষিরা এক ঝুড়ি পাকা টমেটো ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আগে যার দাম ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। তার পরও ক্রেতা মিলছে না হাটে। এই হলো আমাদের খাদ্য জোগানদাতা কৃষক ভাইদের অবস্থা।

সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে কৃষক রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে দানাশস্য, শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করেন, তাকে যদি লোকসান দিয়ে সেগুলো বিক্রি করতে হয়, তাহলে তার চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। এ অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া দরকার। এ জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক হিমাগার ও অঞ্চলভিত্তিক কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া বিদেশে অধিক পরিমাণে কৃষিপণ্য রফতানিরও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চালের পরিবর্তে কৃষকের কাছ থেকে যৌক্তিক মূল্যে সরকারিভাবে ধান কেনা ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য কৃষিপণ্যের জাতীয় মূল্য কমিশন গঠনের বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষককে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য অনতিবিলম্বে দেশে কৃষি বীমার প্রচলন করতে হবে।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist