ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মতামত

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

সংবাদমাধ্যম এবং বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের আপত্তির মুখে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন বাতিল নিঃসন্দেহে সরকারের শুভবুদ্ধিরই পরিচায়ক। তবে মন্ত্রিসভায় যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদন করা হয়েছে তাতে ঘুরেফিরে ৫৭ ধারা বহাল রাখা হয়েছে কি-না সেটি বড় মাপের একটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আইনের ৩২ ধারাটি স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বাধা হবে বলে মনে করছেন সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ। আইনটি নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত সোমবার মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়। এর মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করলেও নতুন আইনে ৫৭ ধারার বিষয়বস্তুগুলো চারটি ধারায় ভাগ করে রাখা হয়েছে। এ জন্য আলাদা আলাদা শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে। আইসিটি আইনে ৫৭ ধারায় মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো-সংক্রান্ত বিষয়গুলো একত্রে ছিল।

নতুন আইনের ৩২ ধারা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি উঠেছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- হবে। কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- ভোগ করতে হবে।

এ ছাড়া মিথ্যা বা অপমানজনক সংবাদ প্রকাশ করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর; ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার ও আইন অবমাননাকর সংবাদ প্রকাশ করলে ১০ বছর কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সংবাদ সংগ্রহের জন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিনা অনুমতিতে প্রবেশ ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়ে কোনো কিছু রেকর্ড করাসহ গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদ- দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে করে কোনো পুলিশ কর্মী যদি মনে করেন, এই আইনের আওতায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাহলে তিনি ওই অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আদালতের গ্রেফতারি

পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবেন। নতুন এ আইন শুভঙ্করের ফাঁকি এমন কথাও জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। তার পরও আমরা সরকারকে সাধুবাদ জানাতে চাই বহুল সমালোচিত ৫৭ ধারা বাতিলের ঔদার্য দেখানোর জন্য; এ আইন

যে ভালো আইন নয় তা প্রকারান্তরে স্বীকার করার জন্য। আশা করব ৩২ ধারার প্রস্তাবিত আইনে বাতিলকৃত আইনের আছর থাকলে তা পাস করার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করা হবে।

নতুন আইনের ১৪টি ধারা জামিন-অযোগ্য হওয়ায় তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যত্যয় ঘটাবে কিনাÑসে বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। আইনকে যেমন অপরাধ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায় তেমন হয়রানির মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে স্বচ্ছতার অভাব থাকলে তারা আইনকে ছেলের হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলবেন না, এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ইতোমধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল নতুন আইনটি যাতে সত্য প্রকাশে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় তা খেয়াল রাখার তাগিদ দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনলেও বহু ক্ষেত্রে তা যে অভিশাপ হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে তাতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এ অভিশাপের কারণ তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার; যা নাগরিকদের জীবন কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্বিষহ করে তুলছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ তথা নাগরিকদের সুরক্ষায় আইনি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এ আইনের যাতে অপপ্রয়োগ না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণে আইন যাতে অস্ত্র না হয়ে ওঠে সে বিষয়ে সতর্ক থাকাও জরুরি। এ বিষয়ে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, আইনের অপপ্রয়োগ হবে না এ ধরনের কর্তৃপক্ষীয় আশ্বাসে আশ্বস্ত হওয়ার অবকাশ নেই। আইনি কাঠামোর মধ্যেই সত্য প্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা থাকতে হবে। রাষ্ট্রকে নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নতুন আইনে এমন সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, গণমাধ্যম বা সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা দেশ, জাতি ও সরকারের জন্য প্রকারান্তরে কল্যাণ নিশ্চিত করে। নতুন আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণেœর কোনো সুযোগ থাকলে তা যে আত্মঘাতী বলে বিবেচিত হবে, সময় থাকতে বিষয়টি উপলব্ধি করাই মঙ্গল।

পরিশেষে বলছি, এতে স্বাধীনভাবে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব

করা হয়েছে। খসড়া আইনটি বাস্তবায়ন করা হলে শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই

খর্ব হবে না, বরং স্বাধীনভাবে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকেও বাধাগ্রস্ত করবে।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist