আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ২৪ মার্চ, ২০১৯

বিশ্বজুড়ে ‘জাসিন্ডা ম্যানিয়া’

শান্ত এক শুক্রবারের দুপুরে লোকজন যখন নামাজের জন্য ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে জড়ো হয়েছিলেন এর কিছুক্ষণ পরই এক ব্যক্তি অ্যাসাল্ট রাইফেল হাতে দরজায় এসে দাঁড়ায়। তার হাতে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অস্ত্র দেখা সত্ত্বেও এক আফগান মুসল্লি তাকে ‘ভাই, আসুন’ বলে স্বাগত জানান। এরপরই সে বন্দুকধারী শুরু করে গুলিবর্ষণ।

এই হত্যাকা- কেবল নিউজিল্যান্ডকে ভারাক্রান্ত করেনি, বিশ্বজুড়ে মানুষকে আলোড়িত করেছে। এই হামলা ইঙ্গিত দিয়েছে, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই কিছু একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্বব্যাপী বিস্তারের কারণে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ব্যক্তি হামলা চালিয়ে ৫০ জন মুসল্লিকে হত্যার ফুটেজ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে অনেকে।

প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি অস্ট্রেলীয় নাগরিক এবং হামলার শিকার হতাহত ব্যক্তিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। যাদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিসর, জর্ডান এবং সোমালিয়া আছে। তাই যখন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর বিবৃতি প্রদানের জন্য হাজির হলেন তখন শুধু নিউজিল্যান্ডই তার বক্তব্য শুনতে উদগ্রীব ছিল তেমন নয়, বিশ্বের মনোযোগ ছিল সেদিকে। দ্রুত ও স্পষ্টভাবে তিনি এই বন্দুক হামলাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেন।

অনেকেই মনে করেন, শ্বেতাঙ্গ কোনো ব্যক্তির দ্বারা এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে (এমনকি সেটা যদি রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবেও হয়ে থাকে) কর্তৃপক্ষ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে অনীহা বা অনিচ্ছুক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু আরডার্ন দ্রুত স্পষ্ট ভাষায় এটাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বক্তব্য দেওয়ার ফলে এই বিষয়ে তার সচেতনতা এবং বিবেচনার বিষয়টি ওঠে আসে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের শোক এবং ভীতির প্রতি তার স্বীকৃতিও সেখানেই ফুরিয়ে যায়নি।

ক্রাইস্টচার্চে ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর স্বজনদের জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না ও সমবেদনা জানান তিনি। এ সময় মাথায় কালো রঙের স্কার্ফ পরেন তিনি যা তাদের প্রতি শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি মানুষকে একতার বন্ধনে বেঁধেছেন এবং বলেছেন, ‘তারা আমাদের’। এর কয়েক দিন পরে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি সংক্ষিপ্ত কিন্তু দৃঢ় ভাষায় বক্তব্য রাখেন যেখানে ইসলামী কায়দায় সবাইকে সম্ভাষণ জানান, ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে।

কিন্তু তিনি এই সহানুভূতির সঙ্গে বাস্তবসম্মত আইনি ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতির মিশ্রণ ঘটান। হামলার ঘটনার কয়েক ঘণ্টার পরই তিনি দেশের অস্ত্র আইনে ‘১০ দিনের মধ্যে’ কঠোর সংস্কার আনার বিষয়ে ঘোষণা দেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সঙ্গে আলাপের সময় তিনি নিউজিল্যান্ড এবং বিশ্ব থেকে বর্ণবাদ ‘বিতাড়িত’ করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ‘সীমানা দিয়ে ভাবলে আমাদের চলবে না’।

সর্বশেষ গত শুক্রবার আল নুর মসজিদের সামনে হেগলি পার্কে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে যোগ দেন জাসিন্ডা আরডার্ন। সে সময় তার মাথা স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা ছিল। তিনি বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে পুরো নিউজিল্যান্ডই ব্যথিত। আমরা সবাই এক।’ তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, বিশ্ববাসী পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিয়ে একটি শরীরের মতো থাকবেন। যখন শরীরের কোনো অঙ্গে ব্যথা হয় তখন পুরো শরীরে ব্যথা হয়।’

আরডার্নের প্রথম বক্তব্যের সূত্র ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের পর্যবেক্ষকরা তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে সুজানে মুর লিখেছেন, ‘মার্টিন লুথার কিং বলেছেন সত্যিকারের নেতারা ঐক্য খোঁজে না তারাই ঐক্য তৈরি করে, আরডার্ন ভিন্ন ধরনের ঐক্য তৈরি, কর্ম, অভিভাবকত্ব ও একতার প্রদর্শন করেছেন। সন্ত্রাসবাদ মানুষের মাঝে ভিন্নতাকে দেখে এবং বিনাশ ঘটায়। আরডার্ন ভিন্নতা দেখেছেন এবং তাকে সম্মান করতে চাচ্ছেন, তাকে আলিঙ্গন করছেন এবং তার সঙ্গে যুক্ত হতে চাচ্ছেন।’

ওয়াশিংটন পোস্টের ঈশান থারুর লিখেছেন, ‘আরডার্ন তার জাতির শোক এবং দুঃখ এবং তা নিরসনের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেছেন।’ এবিসি অস্ট্রেলিয়ার ওয়েবসাইটে অ্যানাবেল ক্র্যাব লিখেছেন, ‘একজন নেতার জন্য ভয়াবহ বাজে খবরের মুখোমুখি হওয়ার পর... মিস আরডার্ন এখন পর্যন্ত কোনো ভুল পদক্ষেপ নেননি।’

গ্রেস ব্যাক এক বাক্যে ম্যারি ক্লেয়ার অস্ট্রেলিয়াতে যেটা লিখেছেন, ‘একজন নেতা এমনই হয়ে থাকেন’।

এই ধরনের প্রশংসার ব্যাখ্যা কেবল বিশ্লেষকদের কাছ থেকেই আসছে তেমনটি নয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান গত শুক্রবার বলেছেন, ‘হামলার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের প্রতিক্রিয়া ও সহমর্মিতা বিশ্ব নেতাদের কাছে একটি উদাহরণ।’ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মোহাম্মদ ফয়সাল বলেছেন, আরডার্ন পাকিস্তানিদের ‘হৃদয় জয়’ করেছেন। মার্টিন লুথার কিং-এর স্মৃতি সংরক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত মার্টিন কিং সেন্টার টুইটারে লিখেছে, ‘নিউজিল্যান্ডে একজন নেতার ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী’।

তার কথা আলোড়িত করেছে নিউজিল্যান্ডের শোকাহত পরিবারের মানুষদের। নিউজিল্যান্ডে বিবিসির সংবাদদাতা হিউয়েল গ্রিফিথ বলছেন, আরডার্ন এর বক্তব্য আমরা এক, তারা আমাদের ক্রাইস্টচার্চের হতাহত পরিবারের মানুষদের মুখ থেকে শুনেছি। এমনকি বিরোধী ন্যাশনাল পার্টির জুডিথ কলিন্স প্রধানমন্ত্রী ‘অসাধারণ’ বলে পার্লামেন্টে উল্লেখ করেছেন।

নিউজিল্যান্ডে রাজনৈতিক বিশ্লেষক কলিন জেমস বিবিসি নিউজকে বলেছেন, আরডার্নের সঙ্গে বেশকিছু সময় কাটিয়ে তার মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী যে সমস্ত প্রশংসা বাক্য পাচ্ছেন তা বিস্ময়কর কিছু নয়। তিনি দৃঢ়, গম্ভীর, ইতিবাচক এবং দায়িত্বশীল এবং যেটা আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, তার শরীরে কোনো বাজে কোষ নেই, কিন্তু আবার তাকে সহজে প্রভাবিত করা যায় না, এটা একটা ব্যতিক্রমী সমন্বয়।

২০১৭ সালে আরডার্ন যখন প্রথম তার নির্বাচনী প্রচার কাজ শুরু করেন তাকে নিয়মিতভাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে তুলনা করা হতো। বলা হতো, এই তিনজনই প্রগতিশীল, উচ্চাকাক্সিক্ষ এবং তরুণ। আরডার্ন যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তখন তার বয়স ৩৭ বছর এবং তাকে ঘিরে ব্যাপক উন্মাদনা তৈরি হয় যার নামকরণ করা হয় ‘জাসিন্ডা ম্যানিয়া’ এবং তিনি শেষ পর্যন্ত ‘অসার পদার্থে পরিণত’ হন কি না তা নিয়ে তখন অনেকেই এমনও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

সুশীল অ্যারোন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লিখেছেন, ‘তিনি ডানপন্থি শক্তিশালীদের ভিড়ে দৃঢ় প্রগতিশীল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ওঠে আসছেন...যার ক্যারিয়ারে গড়ে ওঠেছে উদারতাহীন, মুসলিমবিদ্বেষী আড়ম্বরের মধ্যে।’

এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যেখানে আরডার্নকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, আমেরিকা কী ধরনের সহায়তা দিতে পারে? উত্তরে তিনি বলেছেন, সব মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সহমর্মিতা ও ভালোবাসা। সূত্র : বিবিসি বাংলা, রয়টার্স।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close