আবদুল আলীম, নারায়ণগঞ্জ

  ১১ জুলাই, ২০২০

৬০ কোটি টাকার চারা অবিক্রীত

নারায়ণগঞ্জে নার্সারি ব্যবসার দুর্দিন

নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে গত ৮ মার্চ থেকে কার্যত লকডাউন শুরু হয়। এতে বন্ধ হয়ে যায় অনেক কলকারখানা। কিন্তু নার্সারি পেশার সঙ্গে যারা জড়িত তারা তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে পারেননি। কারণ চারার পরিচর্যা না করলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তারা চারা রক্ষণাবেক্ষণ ও উৎপাদন চালিয়ে যেতে হয়েছে। এদিকে করোনাকালের দুঃসময়ে বিক্রি না হওয়া এসব চারা নিয়ে নার্সারি মালিকেরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানালেন নারায়ণগঞ্জ নার্সারি মালিক সমিতির সভাপতি খাজা হেশাম উদ্দিন চিশতি। তিনি জানান, জেলায় বড় নার্সারির সংখ্যা ৬০টির মতো হবে। ছোট বড় মিলিয়ে মোট ২০০ নার্সারিতে ১ হাজার লোক কর্মরত আছেন। করোনাকালে বেচাকেনা না থাকায় সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অনেক মালিক কর্মচারী ছাঁটাই করছেন। বেতন দিতে পারছেন না অনেকে। নার্সারি ব্যবসায়ীরা সরকারি কোনো প্রণোদনা পাননি।

নারায়ণগঞ্জ মহানগরী এবং জেলার বিভিন্ন স্থানে ২০০টি নার্সারি রয়েছে। এসব নার্সারিতে প্রতি বছরই লাখ লাখ চারা উৎপাদন এবং বিক্রি করে থাকে। ২০ টাকা থেকে শুরু করে আড়াই লাখ টাকা দামের চারাও রয়েছে নার্সারিগুলোতে। ১০ থেকে ২০ হাজার থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দামের অসংখ্য বনসাই রয়েছে নার্সারিতে। রয়েছে ১ থেকে ২ হাজার টাকা দামের ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ। নারায়ণগঞ্জের ২০০টি নার্সারিতে এক হাজারেরও বেশি লোকবল কর্মরত রয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের চারা উৎপাদন এবং বিক্রির এই কার্যক্রমে ১০০ কোটিরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক নার্সারি মালিক বলেছেন, প্রতি বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শীতকালীন ফুলসহ বিভিন্ন ধরনের চারা উৎপাদন এবং বিক্রি করা হয়। এছাড়া মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চার মাস চারা রোপণের মূল মৌসুম। এই সময়কালেই লাখ লাখ চারা বিক্রি হয়। চট্টগ্রামে এই সময় বৃক্ষমেলা এবং বৃক্ষরোপণের নানা কর্মকান্ডে কয়েক কোটি চারা বিক্রি হয়। কিন্তু চলতি বছরের ভরা মৌসুমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো ধরনের বৃক্ষমেলা বা বৃক্ষরোপণ অভিযান হয়নি। স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন ক্লাব বন্ধ থাকায় কোথাও বৃক্ষরোপনের কোনো আয়োজন নেই। এতে করে শহর এবং গ্রাম-গঞ্জের নার্সারিগুলোতে উৎপাদিত লাখ লাখ চারা আটকা পড়ে।

কোথাও কোনো চারা বিক্রি হচ্ছে না উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একাধিক নার্র্সারি মালিক বলেন, অন্যান্য বছর বাসা বাড়িতেও প্রচুর চারা বিক্রি হতো। বৃক্ষমেলা কিংবা বৃক্ষরোপণ অভিযানের বাইরেও বিভিন্ন ধরনের হকার ভ্যানে চারা নিয়ে শহরের বাসাবাড়িতে বিক্রি করতেন। এবার সেই সুযোগও হয়নি। কোনো বাসাবাড়িতেই কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। করোনার জন্য অনেক দিন গাড়ি চলাচল না করায় আমাদের কাছেও কেউ চারা কিনতে আসেননি। আমাদের উৎপাদিত সব চারাই নার্র্সারিতে পড়ে আছে।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ নার্র্সারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নান্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অবস্থা খুবই ভয়াবহ। আমাদের নার্সারিগুলোতে কয়েক কোটি চারা আটকা পড়ে আছে। এসব চারার দাম কোটি টাকারও বেশি হবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের নার্র্সারিগুলোতে বহু নামিদামি গাছের চারা আছে। একটি চন্দন গাছের চারা আড়াই লাখ টাকা বিক্রি করার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এই ধরনের মূল্যবান চারার পাশাপাশি ২০ টাকা দামের চারাও আছে। শহরের জামতলা এলাকায় ভাই ভাই নার্সারিতে প্রতি বছর কমপক্ষে ২ থেকে ৩ লাখ বিভিন্ন ধরনের চারা বিক্রি করেন বলে উল্লেখ করে নুরুল ইসলাম বলেন, এবার সর্বসাকুল্যে ১০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। ব্যবসা পুরোপুরি লাটে উঠার উপক্রম হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিটি নার্সারি প্রতিদিনই লোকসান গুনছে। করোনার কারণে নার্সারি শিল্প পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকার আমাদের সবাইকে গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। প্রত্যেককে কমপক্ষে দুটি করে গাছ লাগাতে বলেছেন। সবাই গাছ লাগালে পরিবেশ ভালো থাকবে বলেও তিনি জানান।

ভাই ভাই নার্সারির সেলসম্যান তোবারক মিয়া বলেন, করোনার সময় এখন চারার দাম বেশি। গাড়ি ভাড়া বেশি। কাস্টমারও নামছে না। আগে দৈনিক ২০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হতো। এখন বেচাকেনা ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। ২ থেকে ৩ মাস মানুষ বাসা থেকে বের হয়নি। লকডাউন খোলার পর কিছু লোক আসে। আমরা বিভিন্ন ফলের গাছ অন্য জেলা থেকে নিয়ে আসি। যেমন, আম, জাম লিচু ও পেয়ারার কলম আনি সাভার, বরিশাল, বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর জেলা থেকে। করোনার আগে কাস্টমার আসতো। এখন লোকজন ভয়ে আসেন না। আমরা শৌখিন লোকজনের বাড়িতে গিয়ে গাছ দিয়ে আসতাম। বাগান সাজিয়েও দিয়ে আসতাম। এখন কেউ সেভাবে অর্ডার করে না। আগে পিকআপ ভ্যানে ভরে অনেকে গাছ নিতেন। জামতলা এলাকার রূপসী বাংলা নার্সারির সেলসম্যান অনিক জানান, এখন বেচাকেনা কম। আগে দৈনিক বেচাকেনা ছিল ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। এখন তা কমে গেছে। আমরা দুজন স্টাফ ছিলাম। একজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে স্টেডিয়াম এলাকায় জন্মভূমি নার্সারিতে কথা হয় পলাশের সঙ্গে। তিনি বলেন শহরের নার্সারির বেচাকেনা ভালো। আমরাতো শহরের বাইরে। বেচাকেনা নেই। করোনার আগে ভালো ছিলাম। পাঁচজন স্টাফ ছিল দুজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আগে মাসে দেড় দুই লাখ টাকা বেচাকেনা হতো। এখন বেচাকেনা হয় না। এ বিষয়ে নার্সারির মালিক ও সমিতির সভাপতি খাজা হেশাম উদ্দিন চিশতি বলেন, আমাদের এক একটি নার্সারিতে অনেক টাকার বিনিয়োগ থাকে। আমরা নিজেরা যেমন চারা উৎপাদন করি আবার বিভিন্ন সোর্স থেকে চারা কেনা হয়। আমাদের প্রতিটি নার্সারির শুধু অফিস বা বিক্রির জায়গাই নয়, চারা উৎপাদনের জন্য প্রচুর ভূমি লিজ নিয়ে রাখতে হয়েছে। নার্সারির প্রত্যেকটি খাতেই টাকার দরকার বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৩ কোটি চারাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিটি নার্সারির মালিককে বিপুল অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। দেশকে সবুজ রাখার আন্দোলনে আমরা অগ্রণী ভূমিকা রাখি। প্রতি বছর আমরা কোটি কোটি চারা উৎপাদন এবং বৃক্ষায়ণে ভূমিকা রাখি। এখন আমাদের জীবনই রঙহীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিনি অস্তিত্ব সংকটে পড়া নার্সারিগুলোকে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close