বদরুল আলম মজুমদার ও নাঈমুল হাসান, ইজতেমা ময়দান থেকে

  ২০ জানুয়ারি, ২০২০

আখেরি মোনাজাতে শেষ দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা

মুসলিম উম্মাহর সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া ও আখিরাতের মঙ্গল কামনা করে গতকাল রোববার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এ মোনাজাতের মাধ্যমে সবাইকে দ্বীনি দাওয়াতের পথে আনার জন্য বিশেষভাবে দোয়া কামনা করা হয়। বিভিন্ন দোয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমিন, আল্লাহুমা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয় ইজতেমা ময়দান। মোনাজাত শুরু হতেই এলাকাজুড়ে এক রকম স্থবিরতা নেমে আসে আর থেকে

থেকে ভেসে আসছিল শুধু আমিন, আমিন। পাপমুক্তির আশায় আল্লাহর দরবারে হাত পেতে চোখের জলে ভাসেন পরহেজগার মানুষ। তাদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে তুরাগতীরের আকাশ। জীবনের সব পাপ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহ ভিক্ষা করেন মুসল্লিরা। লাখো মানুষের সঙ্গে একই সময়ে হাত পেতে মোনাজাতে অংশ নিতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।

আর এ আখেরি মুনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে সা’দ অনুসারীদের ৫৫তম ইজতেমা। গতকাল বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে শুরু হওয়া প্রায় ১৮ মিনিটের এ মোনাজাতে অংশ নেন লাখো মুসল্লি। মোনাজাত পরিচালনা করেন নিজামুদ্দিনের শূরা সদস্য মাওলানা জমশেদ।

আরবি ও বাংলা ভাষায় মোনাজাত করেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে হাত তুলেন লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি। আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বিপদ-মুসিবত থেকে মানবজাতিকে হেফাজত করার জন্য দুই হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। দেশ-বিদেশের প্রায় অর্ধকোটি মুসল্লি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে ফজরের নামাজের পরই হেদায়েতি বয়ান দেন নিজামুদ্দিনের শূরা সদস্য মাওলানা জমশেদ। তবে আখেরি মোনাজাতের আগে দিকনির্দেশনামূলক হেদায়েতি বয়ানে বলা হয়, ইমান, আখলাক, মুসলিম জাতীর ঐক্য, জান, মাল ও সময় দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার কাজ তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ কাজ নবীদের কাজ। প্রতিটি উম্মতের ওপর এই কাজ ফরজ।

আখেরি মোনাজাতে মানুষের ঢল : আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে গতকাল রোববার ফজরের নামাজের পর থেকেই রাজধানী ঢাকা, টঙ্গী, গাজীপুর ও আশপাশের এলাকাগুলো থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ ইজতেমা মাঠের দিকে যেতে থাকে। সকাল ৬টার পর উত্তরা থেকে গাজীপুরের বোর্ডবাজার ও চৌরাস্ত পর্যন্ত ৩-৪ কিলোমিটার এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ইজতেমার আশপাশের মাঠ, কল-কারখানা, হাসপাতাল, দোকানপাট, ভবনের ছাদ ও নৌকাসহ প্রায় সর্বত্রই মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। স্থান সংকুলান না হওয়ায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও টঙ্গী-আশুলিয়া সড়ক এবং তুরাগ নদের ওপর থাকা নৌকা ও লঞ্চে অবস্থান নিয়ে বহু মানুষ মোনাজাতে শরিক হন। গাজীপুর জেলা প্রশাসন ইজতেমা ময়দানের চারপাশে বেশ খানিকটা দূর পর্যন্ত মাইক সম্প্রসারণ করে। এতে দূরে বসে অনেকেই মোনাজাতে অংশ নেয়।

টানা তিনবারের মতো বাংলাদেশে ইজতেমা পালন করতে এসেছেন সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের মোহাম্মদ হাসান। এবারের ইজতেমা পালন করতে এসে কথা হয় প্রতিদিনের সংবাদের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। আলাপকালে মোহাম্মদ হাসান বলেন, এবার তারা কয়েকজন মিলে ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশ শান্তির দেশ। এখানে ইসলাম চর্চা বেশি। আপ্যায়নপ্রিয় মানুষ। এ দেশে আসতে পেরে আমরা সত্যিই খুব ভাগ্যবান। প্রতি বছর ইজতেম পালন করতে আসেন তার দেশের শত শত মানুষ। এখানের নিরাপত্তা খুব ভালো। তবে ইজতেমাকে ঘিরে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় অন্যবারের চেয়ে এবার বিদেশি মুসল্লির সংখ্যা অনেকটাই কম। ইসলাম ভেদাভেদ সমর্থন করে না। তাই এ মতপার্থক্য নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেওয়াই উচিত।

৭ মুসল্লির মৃত্যু : ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় নরসিংদীর বেলাব থানার সুরুজ মিয়া (৬০), ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানা এলাকার গোলজার (৪০) মারা যান। গত শুক্রবার রাতে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানার পূর্ব আজিমনগর গ্রামের মনির হোসেন (৬৫), রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার উসমানপুর এলাকার হাজী জয়নাল আবেদীনের ছেলে হুমায়ুন কবীর (৬৫), বার্ধক্যজনিত কারণে আর গাইবান্ধার সাঘাটা থানার কামালের পাড়া গ্রামের ভিক্ষু হাজীর ছেলে আব্দুস ছোবহান (৬৫), হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ঝিনাইদহ সদর থানার কালাহাট গোপালপুর গ্রামের আ ফ ম জহুরুল আলম (৬২) ও ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানার নলভোগ ফজলু মিয়ার ছেলে ইলিয়াস মিয়ার (৮৫) মৃত্যু হয়।

যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ : যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। শনিবার মধ্যরাতের আগেই ঢাকা থেকে আসা যানবাহনগুলো আবদুল্লাহপুর থেকে কামারপাড়া অভিমুখে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল থেকে ঢাকাগামী যানবাহনগুলো ভোগড়া চৌরাস্তা এবং সিলেট থেকে ঢাকাগামী যানবাহনগুলো টঙ্গীর নিমতলীতে আটকে দেওয়া হয়েছে।

গণমাধ্যমে মোনাজাত: ইজতেমা ময়দানে আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে না পারায় অনেকে রেডিও, টেলিভিশনের মাধ্যমে মুনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। এবারের বিশ্ব ইজতেমায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ৮ হাজারের অধিক পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি রয়েছে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে আকাশে র‌্যাবের হেলিকপ্টার টহল, নৌপথে স্পিডবোটে সতর্ক টহল ও নজরদার। আকাশ ও নৌপথের পাশাপাশি সড়ক পথগুলো খালি চোখ ছাড়াও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাইনোকুলার দিয়ে মুসল্লিসহ সকলের চলার পথ ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

বাড়ি ফেরায় চরম দুর্ভোগ ঃ মুনাজাত শেষে মুসল্লিগণ তাদের ফিরতি যাত্রায় চরম ভোগান্তির শিকার হন। যানবাহন পর্যাপ্ত না থাকায় অনেককে পায়ে হেঁটে,ভ্যানে চড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দেখা যায়। দীর্ঘ সময় যানচলাচল বন্ধ থাকায়, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কিছু বেগ পেতে হয় পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে। আখেরি মোনাজাতের পর মহাসড়ক ও শাখা সড়কগুলোতে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে। মহাসড়কে পর্যাপ্ত যানবাহন না পেয়ে মুসল্লিরা হেঁটে সামনের দিকে এগোতে থাকে। অন্যদিকে বিভিন্ন জেলা থেকে মুসল্লিদের নিয়ে আসা যানবাহনের বিক্ষিপ্ত চলাচলে মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী রেলস্টেশনে মুসল্লিদের ভিড় ছিল আরো বেশি। প্রতিটি ট্রেনে তিল ধারণে ঠাঁই ছিল না। আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লি ও আগের রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, বিভিন্ন মিল কারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরি মুনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়।

ভিআইপিদের অংশ গ্রহণ: এছাড়াও ইজতেমায় মুনাজাতে অংশ নেন- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেদ হক,যুব ও ক্রিড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল,গাসিক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম,গাজীপুর জেলা প্রসাশক তরিকুল ইসলাম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আনোয়ার হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। এছাড়া বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দেন সাকিব আল হাসান, বাঁহাতি ব্যাটসম্যান শাহরিয়ার নাফীস, বাঁহাতি স্পিনিং অলরাউন্ডার সোহরাওয়ার্দী শুভসহ বেশ কয়েকজন জাতীয় ক্রিকেটার উপস্থিত ছিলেন বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতে। আখেরি মোনাজাতে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে দোয়া করেছেন সাকিব-নাফীসরা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close