মারুফ আহমেদ, কুমিল্লা

  ২২ আগস্ট, ২০১৯

কুমিল্লায় ময়নামতি প্রাসাদ

নষ্ট হচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

কুমিল্লার ঐতিহাসিক লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের সর্ব উত্তর প্রান্তে বিচ্ছিন্ন টিলায় রানি ময়নামতি প্রাসাদের অবস্থান। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সর্বপ্রথম খনন কাজ হয় এখানে। এরপর একে একে আরো চার দফা খনন কাজ হয়। ৮ শতক থেকে ১২ শতকের এই পুরাস্থাপনার ধ্বংসাবশেষ থেকে চারটি বসতি আমলের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দফা খননের সময় এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে মাটির ভাঙা পাত্র, লোহার পেরেকসহ বিভিন্ন তৈষজপত্রের ভাঙা অংশ। এছাড়াও অষ্টম শতাব্দীর একটি গোপন পথ। কিন্তু খননকৃত এলাকাটি বেশকিছু দিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এতে খননকৃত এলাকাটির মাটি ধসে পড়াসহ নষ্ট হচ্ছে সন্ধান পাওয়া প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। ঐতিহাসিক ময়নামতির এই এলাকাটি প্রশাসনিকভাবে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নে অবস্থিত। কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের উত্তর-পূর্ব পাশে বিচ্ছিন্ন একটি টিলায় প্রাসাদ এলাকাটির অবস্থান। এখানে খননের ফলে আবিষ্কৃত ক্রুশাকৃতি পুরাস্থাপনার সঙ্গে শালবন বিহারের প্রথম আমলের কেন্দ্রীয় মন্দিরের সাদৃশ্য রয়েছে। চারটি নির্মাণ যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়া এই পুরাস্থাপনার উত্তর-দক্ষিণে ১৫৫ দশমিক ৪৫ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫২ দশমিক ৪০ মিটার প্রাচীর ঘেরা ছিল যা এখন শুধুমাত্র সীমানা চিহ্ন বহন করে। এখানে বিগত সময়ে আবিষ্কৃত পুরাবস্তুগুলোর মধ্যে অন্যতম পোড়ামাটির চিত্রফলক। কয়েকটি ফলকের দৃশ্যে আড্ডায় একাধিক পুরুষ, শিকারসহ নকুল জাতীয় একটি প্রাণী, নরসিংহ, বামন, কচ্ছপ, মহিষ, রাজহাঁস, রূপান্বিত ময়ূর, হামাগুঁড়ি দিয়ে শিশুর সঙ্গে খেলায় মত্ত মা, কিষাণের হালকর্ষণ, দুটি চতুষ্পদ প্রাণীর মৈথুন্য, কিন্নর, লোহার পেরেক, ভাঙা তৈষজপত্র ইত্যাদি। এছাড়াও আবিষ্কৃত কয়েকটি ইটে পিরামিড ও পদ্মপাপড়ি রূপচিহ্ন আছে। রানি ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায় মাঝামাঝি অংশে আবিষ্কৃত ঢিবির ওপর উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আগরতলার তৎকালীন মহারাজা কুমার কিশোর মানিক্য বাহাদুর তার স্ত্রী মনমোহিনীর জন্য একটি আধুনিক বাগানবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। সেই থেকে এই এলাকাটি ‘রানির বাংলো’ নামে অধিক পরিচিতি পায়।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির ফলে কুমিল্লা তৎকালীন পাকিস্তানের অংশে পড়ে। এরপর থেকেই বলতে গেলে রানি ময়নামতি প্রাসাদ এলাকাটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। অনেকটা গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয় এই এলাকা। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খননের সময় রানি ময়নামতি প্রাসাদের দক্ষিণ দিকের সীমানা প্রাচীরের কিছু কাজ করা হয়েছিল। তবে প্রায় পুরো অংশ এখনো অরক্ষিত রয়ে গেছে। ফলে অবাধে মানুষজনের চলাচল রয়েছে। দিনের বেলায় প্রতœতত্ত্ব বিভাগের দুজন অস্থায়ী শ্রমিক দেখভালোর দায়িত্বে থাকলেও রাতের বেলা একেবারেই অরক্ষিত।

একাধিক এলাকাবাসী জানিয়েছেন, অনেকেই রাতে এখানে মাদক সেবন করে। বহিরাগতরা এসে আড্ডা দেয়। চারদিকে কোনো বৈদ্যুতিক বাতি না থাকায় অন্ধকার থাকে পুরো এলাকাটি। তবে পশ্চিম পাশে একটি মন্দিরের আলোয় দূর থেকে প্রাসাদটির অবস্থিতি জানান দেয়। এদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খননের পর ওই খননকৃত এলাকাটিও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এতে খননের ফলে আবিষ্কৃত অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর থেকে খননকৃত স্থানগুলোর নিরাপত্তা বিধানে দেওয়া হয়েছে বরই গাছের কয়েকটি কাটাযুক্ত ডালা। উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের পাকিস্তান জাতীয় দল ও ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড ময়নামতির হুমায়ুন কবীর জানান, ভারত বিভক্তির পর কুমার কিশোর মানিক্য বাহাদুর এখানে কয়েকবার এসেছিলেন। তবে রাত যাপন করেননি। তিনি আরো বলেন, রানি ময়নামতি প্রাসাদের চারদিকে সীমানা প্রাচীরের পাশজুড়ে ছিল বকুল, দোলনচাপা, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, কাঁঠালিয়াচাপাসহ বিভিন্ন ফুলের বড় বড় গাছ ছিল। এছাড়াও প্রাসাদের চারদিকে গোলাকার বড় ৪টি ফুলের বাগান ছিল। পাক সেনাবাহিনী সেই বাগান থেকে ৫০ সালের পর বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ তুলে নিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসে রোপণ করেছিল। তিনি আরো বলেন, প্রাসাদের উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল পাঁচটি বট গাছ যা পঞ্চবটিকা নামে পরিচিত ছিল। ১৯৫৬-৫৭ সালে সেগুলো স্থানীয়রা কেটে ফেলে। হুমায়ুন কবীর বলেন, কুমিল্লা পদ্ধতির জনক ড. আখতার হামিদ খান ১৯৫২-৫৩ সালে রাতে প্রায়ই রানি ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায় আসতেন। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলে প্রাসাদ এলাকার বাইরে বৈশাখী মেলা বসত। তবে ১৯৫৬ সাল থেকে অরক্ষিত অবস্থায় থাকা প্রাসাদের চারপাশ এ মেলার দোকানিরা পসরা নিয়ে বসতে থাকে। অরক্ষিত অবস্থায় খননকৃত এলাকা ফেলে রাখার বিষয়ে জানতে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close