রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২২ মার্চ, ২০২০

করোনার আঘাতে বেসামাল পৃথিবী

বর্তমানে সারা বিশ্ব একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে এখন নতুন আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। বিশ্বের ১৭২টি দেশে এখন পর্যন্ত ছড়িয়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি লোক, মারা গেছে ১০ হাজারের অধিক। এর মধ্যে চীনে মারা গেছে ৩ হাজার ১৭৭ জন, ইতালিতে ৩ হাজার ২৬৬ জন, ইরানে ৫১৪ জন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭১ জন। অন্যদিকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। করোনাভাইরাসের আঘাতে বড় ধরনের ধস নেমেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে।

এ ধরনের একটি বিপর্যয়ে বৈশ্বিক জিডিপি ৫ শতাংশ বা প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার কমে যেতে পারে বলে ধারণা করছে বিশ্বব্যাংক। এর আগে ২০০২-০৪ সালে চীন থেকে শুরু হওয়া সার্সে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেবার বৈশ্বিক জিডিপি কমে যায় প্রায় দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৪-১৬ সালে ইবোলাভাইরাসের কারণে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। তবে গত বছরের শেষ নাগাদ চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ ১৭ বছর আগের সার্সের চেয়ে অনেক বেশি ও ভয়ংকর হবে।

অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম প্রান্তিকেই ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়ে গেছে বিশ্বে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে অবহিত করে। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগেও চীনের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছিল না। বিশ্বের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ অর্থবছরে চীনের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নেমে যাবে।

চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলে আশা করা হলেও করোনাভাইরাসের বিপর্যয়ের পর তা ৩ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। বিশ্ব¦জুড়ে ক্ষতির তালিকায় হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে। জার্মান অর্থনীতি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। জাপানের ক্ষেত্রে যা শূন্য দশমিক ৩ শতাংশের বেশি। গত বছরের শেষ দিনে চীনের উহান শহর থেকে শুরু হওয়ার পর বিগত আড়াই মাসেই বিশ্বজুড়ে মহামারী রূপ নিয়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। অদৃশ্য শত্রুর বেপরোয়া হামলার মুখে অসহায় বিশ্বজুড়ে লেগেছে আতঙ্ক আর মৃত্যুর মাতম।

অণুজীব ঘাতকের হামলা ঠেকাতে দিকে দিকে উঠেছে সতর্কতার আহ্বানে, প্রাণান্ত প্রস্তুতি। কিন্তু এসব তৎপরতায় কাজের অগ্রগতি বা ফল মিলছে সামান্যই। পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ব। এমনকি জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে এই ভাইরাস যে কতটা প্রসারিত হয়েছে, তার পরিমাপ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে; কেননা, অনেক দেশেই কারা আসলে অসুস্থ, তা এখনো জানাই যাচ্ছে না। অপ্রস্তুত সরকারগুলো বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেগুলো আদৌ কোনো ফল দেবে কি না, তা নিশ্চিত নয়; প্রতিরোধের ও প্রতিষেধকের ব্যবস্থা নেই বলে কনটেইনমেন্ট হয়ে উঠছে প্রথম পদক্ষেপ। চীনে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপের মুখে উহানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পর অনেকেই সেই পথে এগোচ্ছেন। কিন্তু এই ভাইরাস এখন আর চীনের সীমানার ভেতরে নেই। ছয় শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ইতালি সারা দেশেই কোয়ারেন্টাইন চালু করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কাছে একটি এলাকায় এই ধরনের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা জারি করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে বৈশ্বিকভাবেই এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও বারবার এটা বলা হচ্ছে যে দরকার হচ্ছে সচেতনতা ও সাবধানতা, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনিশ্চয়তার কারণে সাধারণের প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভীতির। এই ভাইরাসের ব্যাপ্তি ও প্রভাব এতটাই যে, কেউ কেউ এই পরিস্থিতি বোঝার জন্য ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ তত্ত্বের আশ্রয় নিচ্ছেন, প্রশ্ন উঠেছে করোনাভাইরাসকে আমরা ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট কালো রাজহাঁসের ঘটনা বলে বর্ণনা করতে পারি কি না। ফরাসি-লেবানিজ-মার্কিন গবেষক নাসিম নিকোলাস তালেব ২০০৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ দ্য ব্ল্যাক সোয়ান : দি ইম্প্যাক্ট অব দ্য হাইলি ইমপ্রোবেবলে এমন সব ঘটনার কথা বলেছিলেন, যেগুলো বিরল ও অনিশ্চিত; যেগুলো সাধারণত মূলধারা বিবেচনার বাইরে থাকে, কিন্তু তার প্রভাব হয় ব্যাপক। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতির দেশ চীন। ২০০৩ সালে ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের চীনা অর্থনীতির আকার এখন ১৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন। এ সময় অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বেড়েছে।

করোনার আঘাতে দেশটির অর্থনীতি ১ শতাংশ কমে গেলেও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। কেননা, ২০০১ সালে বিশ্বের বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেওয়ার পর বিশ্ব কারখানা বলে পরিচিত চীন এখন বৈশ্বিক কাঁচামাল ও ফিনিশড পণ্যের সবচেয়ে বড় সংযোগস্থাপনকারী দেশ। কিন্তু করোনাভাইরাসের অর্ভূতপূর্ব প্রভাব পড়েছে বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রে। শিক্ষা ও জনজীবন স্থবির হয়ে গেছে প্রায় সব দেশে। এ ছাড়া বিশেষভাবে আক্রান্ত দেশগুলো ছাড়াও পরস্পরের অবরোধের আওতায় পড়ে গেছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ। ভাইরাসের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না উন্নত-অনুন্নত কোনো দেশই।

বিশ্বজুড়েই বাতিল করা হয়েছে সব ধরনের আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক ক্রীড়া ও অন্যান্য সমাবেশ। কোথাও কোথাও খেলা চলছে গ্যালারি শূন্য রেখেই। অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে শীর্ষ নেতৃত্বের অংশগ্রহণে পূর্বনির্ধারিত সব ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্মেলন ও সমাবেশ। এসব অঙ্গনের শীর্ষ তারকাদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। জনসমাগমের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকায় বাতিল হয়েছে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট, ম্যাচ ও সব ধরনের কনসার্ট। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখায় মরিয়া দেশের মধ্যেই বিশেষভাবে আক্রান্ত শহরগুলো অবরুদ্ধ করার পাশাপাশি ভিসা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশের ওপর। সব মিলিয়ে করোনার আঘাতে রাতারাতি থমকে গেছে পরিবহনশিল্প।

ইতোমধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। পরিণতিতে অপূরণীয় ধস নেমে এসেছে আন্তর্জাতিক শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে। চরম সংকটে পড়েছে বিমান চলাচল ও পর্যটন খাত। যে কারণে বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা হলো সরবরাহ বিপর্যয়। কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, উৎপাদন হ্রাস ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য কমে যাবে। এমনকি উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ক্যাপিটাল মার্কেটে সূচকের দরপতন হয়েছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের রফতানি আয়ের প্রধান খাত বস্ত্রশিল্পের আমদানি করা কাঁচামালের ৪৬ শতাংশ চীন থেকে আসে।

এ ছাড়া চীন বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে ৯০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, যা বাধাগ্রস্ত হতে পারে করোনাভাইরাসের কারণে। করোনাভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের অর্থনীতিতে যেভাবে আঘাত আনতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে, চীনের অর্থনীতিতে সার্বিক চাহিদা ঘাটতির মাধ্যমে এবং সরবরাহ বাজারের বিপর্যয়ের দ্বারা। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন, হোটেল, পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণবাবদ চীনারা ২৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে। ২০১৯ সালের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে তারা গড়ে ১৮ দিনের মতো অবস্থান করে মাথাপিছু ৭০০০ মার্কিন ডলার খরচ করে। উহান থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫৫টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পৃথিবীর ২০টি দেশে যাতায়াত করত। এখন তা নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়।

আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সমিতির হিসাবে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যাত্রীর সংখ্যা ১৩ শতাংশ কমে যাওয়ায় ২০ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের মতো ক্ষতি হবে। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ১৩ হাজার ফ্লাইট বাতিল হয়ে যাচ্ছে। শুধু চীনা পর্যটকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় হংকং, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। ইতোমধ্যে চীনা পর্যটক কমে যাওয়ায় থাইল্যান্ডের রাজস্ব আয় দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১ দশমিক ৬ মিলিয়নে নির্ধারণ করা হয়েছে। চীনা পর্যটকদের অন্য দেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা থাকায় শুধু নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার ৫৮০ কোটি ডলার ক্ষতি হবে। অ্যাপল তাদের সব অফিস এবং ৪২টি সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করেছে। ব্রিটিশ ব্র্যান্ড বারবেরি তাদের ৬৪ সেন্টারের মধ্যে ২৪টি, স্টার-বাকসের ২০০০-এর অধিক, ম্যাকডোনাল্ড ও ওয়ালমার্ট অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে।

এমনকি সাংহাই ডিজনিল্যান্ড বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়া ক্রুড তেল আমদানিতে চীন বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। চীনের চাহিদা কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে ২০ শতাংশ। তেলের দাম কমে যাওয়ায় সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির মুখে রয়েছে। অর্থনীতির অবস্থা যাই হোক না কেন, এটি একটি মানবিক বিপর্যয়। ২০১৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আডহানোন হুশিয়ারি দিয়েছিলেন, যেকোনো সময় একটা প্যানডেমিক শুরু হতে পারে এবং তাতে ১০০ মিলিয়ন লোক মারা যেতে পারে।

২০১৮ সালে দেশের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বা সিডিসির মহামারি প্রতিরোধক গবেষণা ও কাজের বাজেট হ্রাস করা হয় প্রায় ৮০ শতাংশ। যে কারণে এখন দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করার যে কিট বা উপকরণ, তা পেতেই সময় চলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের এই আচরণ তার অন্য আচরণ থেকে ভিন্ন নয়, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনকে কিংবা করোনাকে ধাপ্পাবাজি বলার মধ্যেই তার প্রমাণ এখন এক মহামারির মুখে বিভিন্ন দেশে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর সাফল্য দরকার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক এই বৈশ্বিক সংকটের মুখে আর যা দরকার, তা হচ্ছে স্বচ্ছতা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পৃথিবী,করোনাভাইরাস,অর্থনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close