রায়হান আহমেদ তপাদার
আন্তর্জাতিক
উগ্র-জাতীয়তাবাদের আতঙ্কে বিশ্ব
গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর বলে খ্যাত গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপরাসের সঙ্গে বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, বর্ণ-ধর্ম বা জাতিভিত্তিক বিভাজনের বিপদ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ সজাগ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় আসলে পরিবর্তনের জন্য মার্কিন জনগণের কিছু একটা করার তাড়নার ফল। এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভোটাররা নিজেরাও সচেতন ছিলেন না বিধায় সারা বিশ্ব আজ তারই ফল পাচ্ছে। এখনো সময় আছে উগ্র-জাতীয়তাবাদের উত্থান ঠেকাতে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার। গত পঁচাত্তর বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলো সহযোগিতা ও আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতে পথ চলে আসছে। প্রতিটি দেশ একে অপরের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ভাগ করে নিয়েছে। এই ইতিহাস ও সময়কে বিশ্বায়ন বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি রাজনৈতিক হাওয়ার দিক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন এই যুগে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে উগ্র-জাতীয়তাবাদ। যাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইউরোপের নিরাপত্তা ও একাত্মতার হুমকি বলে মনে করছেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বার্তা বহন করেছেন। তার ক্যাম্পেইনে মুসলিম এবং মেক্সিকানদের সমালোচনা করা ছাড়াও অভিবাসন এবং মুক্ত বাণিজ্যের বিরোধিতা করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্সিতে জাতীয়তাবাদ মূলত নৃ-জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। ট্রাম্পের বিস্ময়কর নির্বাচনের পর ইউরোপ আরো কয়েকটি নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। নেদারল্যান্ডসে মার্চে, ফ্রান্সে এপ্রিল ও মে মাসে এবং জার্মানিতে সেপ্টেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উগ্র-জাতীয়তাবাদের ধারকরা এই নির্বাচনগুলোতে জয়ের তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ট্রাম্পের জয় তাদের কাছে এক নতুন আশার আলো।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদপ্রার্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টির নেতা মেরিনি লি পেন বিশ্বায়ন ও অভিবাসনবিরোধী নীতিকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। লি পেন এবং তার বাবা জেন মেইরি টুইটারে ট্রাম্পের জয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে নেদারল্যান্ডস, হাঙ্গেরি, এবং গ্রিসের ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতারাও ট্রাম্পের জয়কে একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছেন। মেরিনি ফ্রান্সকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মেরিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ব্রেক্সিটের পর ফ্রেক্সিটের হাওয়া বইতে শুরু করবে। মাত্র কিছু দিন আগে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল নির্বাচনে আশাতীতভাবে ভালো ফল করে কট্টর অভিবাসনবিরোধী ওয়ান নেশন পার্টি। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে জয়লাভের পর দলটির প্রধান পলিন হ্যানসন তার উদ্বোধনী সিনেট ভাষণে বলেন, অস্ট্রেলিয়া মুসলিমে প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেছিলেন, আমরা আজ মুসলিম সম্প্রদায় ও সামাজিক গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বিপদগ্রস্ত। অস্ট্রেলিয়ানদের মুসলমানদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই দাবি করেন যে অস্ট্রেলিয়ায় সংঘটিত অপরাধের হার মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে বেশি। তিনি অভিবাসন নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ান মুসলিমদের দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেন, ‘আপনারা যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে ফিরে যান।’ এই বিতর্কের পর একটি জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়াতে মুসলিম অভিবাসন নিষিদ্ধের ব্যাপারে সাধারণ অস্ট্রেলিয়ানদের মতামত নেওয়া হয়। তাতে অবিশ্বাস্যভাবে দেখা যায় যে, প্রায় অর্ধেক অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম অভিবাসন নিষিদ্ধের পক্ষে। জরিপের এক তৃতীয় অংশ অস্ট্রেলিয়ান মনে করেন মুসলিম অভিবাসীরা তাদের মূল সমাজের সঙ্গে একীভূত নয়। মুসলিম বা অভিবাসীদের ব্যাপারে ভীতি যে শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই তৈরি হয়েছে তা নয়, এই ধারার বিস্তার ঘটেছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের প্রায় সব স্থানে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে মূলধারার রাজনীতির প্রধান দলগুলো বাধ্য হচ্ছে কথিত ডানপন্থায় ঝুঁকে ভোট ব্যাংক বাড়াতে। আর তার সর্বশেষ উদাহরণ ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যিনি প্রকাশ্যে বিদ্বেষমূলক, অভিবাসীবিরোধী, বর্ণবাদী জনপ্রিয় প্রচারণার জোরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হলেন। আর অভিবাসন নীতি নিয়ে ইউরোপের সঙ্গে বিরোধের জোরে ব্রিটিশ নাগরিকরা ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিলেন। উত্থান ঘটল বর্ণবাদী নেতা নাইজেল ফারাজের। ধারণা করা হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব, বেকারত্বের মতো আর্থিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে মাথাচাড়া দিচ্ছে এই উগ্র-মতবাদ। যেমন-গ্রিসের গোল্ডেন ডন, সংসদে যাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ডেনমার্কের ড্যানিশ পিপলস পার্টিও গত বছরের নির্বাচনে ২১ শতাংশ আসন লাভ করে। আর অস্ট্রিয়ায় এ বছরের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে তো অল্পের জন্য জয়ী হতে পারেনি ডানপন্থী ফ্রিডম পার্টি অব অস্ট্রিয়া (এফপিও)। এছাড়াও ইউরোপের দেশগুলোতে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে এই মতাদর্শের দলগুলো, যেমন-ইতালির লিগা নর্ড, সুইস পিপলস পার্টি, নিউ-নাজি পিপলস পার্টি আওয়ার স্লোভাকিয়া, ইংলিশ ডিফেন্স লিগ, অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি। তবে এ কথাও ঠিক, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বিস্তারের কারণেও এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। যেমন-ফ্রান্সের প্যারিস হামলার পর ২০১৫ সালের আঞ্চলিক নির্বাচনে ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট ২৭ শতাংশ জনপ্রিয় ভোট লাভ করে। ১৯৭২ সালে দলটি গঠিত হওয়ার পর এটায় তাদের সবচেয়ে ভালো ফল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, দেশটিতে মুসলমানদের ওপর ঘৃণাজনিত হামলার মতো অপরাধের পরিমাণ গত এক বছরে ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ নাইন ইলেভেনে টুইন টাওয়ার হামলার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত মুসলমানদের ওপর ঘৃণাজনিত অপরাধের রেকর্ড পর্যালোচনা করে এফবিআই এ প্রতিবেদন তৈরি করে। ২০১৪ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের ওপর এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে ৫ হাজার ৪৭৯টি, এক বছরেই এ হার শতকরা ৬ দশমিক ৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে গত বছর তা হয়েছে ৫ হাজার ৮৫০টি। অথচ বিগত ২০০০ সালে এ ধরনের হামলার ঘটনা ছিল অতি নগণ্য। বিশেষ করে সদ্য সমাপ্ত মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এধরনের হামলার ঘটনা আরো বেড়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অস্ট্রেলিয়ার চিত্র খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়। গত বছর ওয়েস্টার্ন সিডনি ও চার্লস স্টুয়ার্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামিক সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ একাডেমির যৌথ জরিপে জানা সাধারণ একজন অস্ট্রেলিয়ানের তুলনায় একজন মুসলিম অস্ট্রেলিয়ান তিন গুণ বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫৭ শতাংশ বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছেন। শতকরা ৬২জন মুসলিম অস্ট্রেলিয়ায় চাকরি খোঁজার সময় বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছেন। মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের হার ৮.৫-যা জাতীয় বেকারত্বের হার থেকে দুই গুণেরও বেশি। শুধু মুসলিম জনগোষ্ঠীই যে, বর্ণবৈষম্য বা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তা নয়। ভারতীয় ও এশিয়ান বংশোদ্ভূত অনেক অভিবাসীর দাবি, তারাও বর্ণবৈষম্য ও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। বিজ্ঞ মহলের ধারণা, ট্রাম্প, পলিন হ্যানসন, নাইজেল ফারাজ, ম্যারি লো পেনের মূলমন্ত্র হচ্ছে বর্ণবাদী ভয়। ভোটের রাজনীতির ফল নিজের পক্ষে আনার জন্য এই সময়ের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে এটি। উগ্র-জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করলে বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘৃণার বিষবাষ্প। ওলট-পালট করে দিচ্ছে যুগ যুগ ধরে চলা বহুজাতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। আর এই বর্ণবাদী রাজনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সারা বিশ্বের কয়েক কোটি অভিবাসী। অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বজুড়ে উগ্র-জাতীয়তাবাদের এই ক্রমবর্ধমান উত্থান যে, অধিকাংশ অভিবাসীদের দুশ্চিন্তার ও আতঙ্কের কারণ হবে-এ কথা এখন নিশ্চিত করে বলা যায়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্মের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বার্ট বোনিকোস্কি বলেন, ট্রাম্পের নির্বাচন এবং ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়া জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে উৎসাহিত করেছে।
ডানপন্থী জাতিয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো এত বছর ধরে যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই দুটি ঘটনা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় জয়। তারা এটি দেখিয়েছেন যে, বেশিরভাগ মানুষ যা অসম্ভব বলে মনে করে তা আসলে সম্ভব হয়। তিনি আরো বলেন, ডানপন্থীদের জয় নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স এবং জার্মানির সীমান্তে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এত বছর ধরে গণতান্ত্রিক নীতি, বিশ্বাস ভাগাভাগী করে আশা-ঐতিহ্যের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হবে। বোনিকোস্কি বলেছেন, এটি ভৌগোলিক চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন ঘটাবে। যা আগে ঘটেনি সেই সব ঝুঁকির কারণ হবে এই নির্বাচনগুলোর ফল। এর জন্য প্রতিটি দেশে উগ্র-জাতীয়তাবাদী ধারণার প্রেসিডেন্টের প্রয়োজন নেই। দুজনই যথেষ্ট, এমনকি ক্ষমতাশালী একজন নেতাও এই ঝুঁকি ডেকে আনতে পারেন। সিইএসের প্রফেসর গ্রেজজরর্গ ইকরেইত বলেছেন, জার্মানিতে অ্যাঙ্গেলা মারকেল জিতলে হয়তো বিশ্বায়নের ধারণার নেতারা একসঙ্গে লড়বেন, কিন্তু যদি তিনি হেরে যান তাহলে ইইউ আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। ইউরোপ এখন টার্নিং জোনে অবস্থান করছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক, রাশিয়া, চীন ও তুরস্কের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক দোলায়মান। পূর্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শক্তিশালী ছিল, তাই তারা ইইউভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের যেকোনো স্থানে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু এখন এটি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সম্মুখীন।
লেখক : কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য প্রবাসী