মো. মাঈন উদ্দিন

  ০৩ অক্টোবর, ২০১৯

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ

জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিশ্চিত করেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে প্রাধান্য পেয়েছিল রোহিঙ্গা সমস্যা। যে সমস্যাটি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মাথাব্যথার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতিনিয়ত এর প্রসার বাড়ছে। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ভাষণ দেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর কার্যালয়ের ইউনিয়ন মন্ত্রী চিয়াও তিন্ত সোয়ে। এ বিষয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে।

প্রতিবেদনের মতে, প্রত্যাবাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন রুখতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ধ্বংসাত্মক আন্দোলনসহ যেসব বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে; সে সম্পর্কে মিয়ানমার অবগত রয়েছে উল্লেখ করে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর কার্যালয়ের ইউনিয়ন মন্ত্রী চিয়াও তিন্ত সোয়ে বলেছেন, এ সমস্যাগুলো সমাধান করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্র সময় শনিবার এবং বাংলাদেশ সময় রোববার ভোরের দিকে মি. সোয়ে এ ভাষণ দেন। নির্বিঘ্ন এবং সফল প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও উদ্যোগের পাশাপাশি এ বিষয়ে সই করা চুক্তির শর্তও কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে বলে উলেখ করেন তিনি।

এর আগে একই অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাখাইন প্রদেশে সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। কিন্তু মি. সোয়ে বলছেন, মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে যে প্রত্যাবাসন চুক্তি সই করেছে; সেই চুক্তি অনুযায়ীই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আগ্রহী দেশটির সরকার। এ চুক্তির যথাযথ প্রয়োগই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের একমাত্র উপায় বলেও চিহ্নিত করেন তিনি। আর তাই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কঠোরভাবে মেনে চলতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয় ওই ভাষণে।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় নতুন কোনো শর্ত বা উপাদান অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। মি. সোয়ে বলেন, মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার ক্রমাগত আহ্বান রয়েছে। মিয়ানমারের ভেতরে সেফ জোন বা নিরাপদ অঞ্চল তৈরির চাপ রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না এবং এটি বাস্তবসম্মতও নয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলেন মিয়ানমারের ইউনিয়ন মন্ত্রী কিয়াও তিন্ত সুয়ে।

ভাষণে তিনি জানান, কক্সবাজারের শিবির থেকে মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী ৪০০ হিন্দুসহ অন্যদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে। ওদিকে এর ঠিক এক দিন আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার ও তাদের নাগরিকদের মধ্যকার সমস্যার বোঝা বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তিনি আহ্বান রাখেন যেন তারা এই সংকটের বিষয়টি উপলব্ধি করে।

শেখ হাসিনা বলেন, এ সমস্যা এখন আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ক্যা¤েপর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিষয়টি এখন আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি এ এলাকার পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাও ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে চারটি সুপারিশ তুলে ধরেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, প্রত্যাবাসনে যোগ্যদের পরিচয়পত্র বা আইডেন্টি কার্ড দেওয়া হবে এবং মিয়ানমারের নাগরিকত্বের আইন অনুযায়ী যোগ্যদের নাগরিকত্ব কার্ড দেওয়া হবে। বাকিরা ন্যাশনাল ভেরিকেশন কার্ড বা এনবিসির আওতাভুক্ত হবে। মি. সোয়ে বলেন, এ কার্ড জাতিসংঘের অনুমোদিত অভিবাসীদের জন্য দেওয়া গ্রিন কার্ডের মতো হবে। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক অভিযানের পর বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এ পর্যন্ত জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার রাজি হলেও কার্যত দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়েও একজন রোহিঙ্গাকেও স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

মূলত নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ওই দুই দফায় স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে চায়নি কোনো রোহিঙ্গা। সেই সঙ্গে নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিও ছিল তাদের। ২০১৭ সালে সামরিক অভিযানের জেরে সাত লাখের রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘ একে জাতিগত নির্মূল কর্মকান্ডের ‘টেক্সটবুক’ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে নিজেদের বাহিনীর হাতে বড়মাত্রায় হত্যাকান্ডের অভিযোগ নাকচ করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমার বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ, সেনাবাহিনীর হাতে জাতিগত দমন এবং গণহত্যার অভিযোগ ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে আসছে।

তবে এখন তারা বলছে যে, তারা কিছু পরিমাণ শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু গত মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের অনুমোদিত ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে কেউই ফিরতে না চাইলে এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারা অভিযোগ তোলে যে, ২০১৭ সালে সংঘটিত নিপীড়নের জন্য কোনো জবাবদিহি নেই এবং নিজেদের চলাফেরায় স্বাধীনতা ও নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়েও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

শোনা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কোনো কোনো এনজিও বা ব্যক্তি তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য মিয়ানমারে যাওয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করছে। গত মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ার পর রোহিঙ্গারা এক মহাসমাবেশ করে। যাতে তারা সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি-দাওয়া পেশ করে। দাবি-দাওয়াগুলো পূরণ হলেই তারা মিয়ানমারে যাবে জানায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমার জাতিগতভাবেই মিথ্যাচারে অভ্যস্ত। এ কথা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করে প্রতিনিয়ত।

২০১৭ সালে সর্বশেষ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসে। এর পর দুই বছরে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন-সংক্রান্ত বহু ওয়াদা দিয়ে সে-লো ভঙ্গ করেছে। ওয়াদা ভঙ্গ করেছে বাংলাদেশের সঙ্গে। ওয়াদা ভঙ্গ করেছে সারা বিশ্বের সঙ্গে। মূলত সারা বিশ্বকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। সর্বশেষ জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে মিয়ানমারের ভাষণ থেকে স্পষ্ট যে, তারা রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো কখনোই মেনে নেবে না। প্রশ্ন হলো— রোহিঙ্গারা আর কত দিন বাংলাদেশে থাকবে। অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের কর্মকান্ড এ কথাই প্রমাণ করে যে, রোহিঙ্গাদের অবস্থান বাংলাদেশে যত দীর্ঘ হবে; ততই বাড়বে বাংলাদেশের ভোগান্তি। তাছাড়া মিয়ানমারও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ পাবে। সুতরাং অতি দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারলেই মনে হয় আমাদের দায়মুক্তি মিলবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

Email : [email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রোহিঙ্গা,জাতিসংঘ,রোহিঙ্গা ইস্যু,রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close