জুবায়ের চৌধুরী

  ১৬ মার্চ, ২০২০

টাকা দিলেই মেলে নকল সনদ!

আলমগীর হোসেন (ছদ্মনাম)। ২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। পরে একটি বুটিকশপে সেলসম্যানের কাজ নেন। ছয় বছর ধরে তিনি সেখানে কাজ করছেন। প্রতি বছরই সামান্য বেতন বাড়ে। কিন্তু কোনো প্রমোশন নেই তার। কারণ তার কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট নেই। এজন্য প্রমোশনও হচ্ছে না। উপায় না পেয়ে তিনি এক বন্ধুর পরামর্শে নীলক্ষেতের একটি কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে যোগাযোগ করেন। তারা তাকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দুটি (এসএসসি ও এইচএসসি) জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে দেয়। এজন্য তাদের মধ্যে ১০ হাজার টাকায় রফা হয়। একপর্যায়ে ওই জাল সার্টিফিকেট তিনি কর্মস্থলে জমা দেন। যদিও এখন পর্যন্ত তার প্রমোশন মেলেনি। তবে তিনি আশা করেন, খুব শিগগিরই তার প্রমোশন মিলবে। মালিক বলেছেন, কোনো এক শোরুমে তাকে ম্যানেজার হিসেবে বদলি করা হবে, যেকোনো সময়। তিনি আশায় বুক বেঁধে আছেন।

বদরুল আলম (ছদ্মনাম)। একইভাবে জাল সার্টিফিকেট দিয়ে দেড় বছর ধরে একটি বাস কোম্পানিতে সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করছেন। এখন পর্যন্ত তার কোনো সমস্যা হয়নি। শুধু ফারুক কিংবা আতাউর নয়, রাজধানীতে এরকম অনেক যুবকই জাল সার্টিফিকেটে চাকরি করছেন। নীলক্ষেত কেন্দ্রিক একটি সংঘবদ্ধ চক্র জাল সার্টিফিকেট তৈরিতে সহায়তা করছে। আলমগীর হোসেন কিংবা বদরুল আলম নয়, জাল সনদে চাকরি করছেন অনেকেই। নানা কারণে সেটা জানা-বুঝার উপায় থাকে না চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাল সার্টিফিকেট, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, ভোটার আইডি কার্ড, স্কুল-কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের জাল সার্টিফিকেট তৈরি করা হচ্ছে। এমনকি এমবিবিএস কোর্সের সার্টিফিকেটও মিলছে অহরহ। নীলক্ষেত যেন জাল সার্টিফিকেটের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। র‌্যাব-পুলিশ প্রায় অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের ধরে সাজা দিচ্ছে। কিন্তু তাতেও থেমে নেই জাল সার্টিফিকেট তৈরির সিন্ডিকেট। প্রতিদিন আড়ালে আবডোলে চলছে অবৈধ এ রমরমা ব্যবসা। খুবই গোপনে বিভিন্ন কৌশল আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু অসাধু চক্র দিনের পর দিন অবৈধ এ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক জানান, জাল সার্টিফিকেট তৈরির মতো অপরাধ আমাদের সমাজে এখনো ব্যাপকভাবে বাড়েনি। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ এতে যুব সমাজ মারাত্মকভাবে প্রতারিত হচ্ছে। কঠোর আইন আর সামাজিক সচেতনতাই এটিকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা। এর প্রচলন এখনই বন্ধ করতে না পারলে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

কোচিং সেন্টারের আড়ালে সনদের কারবার : কোচিং সেন্টারের আড়ালে জাল শিক্ষা সনদ তৈরি ও বিক্রির অভিযোগে রাজধানীর গুলশান ও বাড্ডা থেকে চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩। তারা হচ্ছেন আজিজুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, শরিফুল ইসলাম ও হায়দার আলী। গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলা এ অভিযানে বিপুল পরিমাণ জাল সনদ ও সনদ তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।

র‌্যাব-৩ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ বি এম ফাইজুল ইসলাম জানান, গোয়েন্দা তথ্য ছিল বারিধারা জেনারেল হাসপাতালের আটতলায় প্রাইভেট স্টাডি একাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান ও মেরুল বাড্ডার প্রগতি টাওয়ারে ৯ তলায় কোচিং সেন্টারের আড়ালে জাল সার্টিফিকেটের ব্যবসা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জিয়াউর রহমান। এ তথ্যে প্রথমে প্রাইভেট স্টাডি একাডেমিতে অভিযান চালানো হয়। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর সময় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যে রাতে মেরুল বাড্ডার কোচিং সেন্টারে অভিযান চালানো হয়। সেখানে অভিযানে গেলে কর্মচারীরা দরজা খুলতে চায়নি। এক পর্যায়ে তারা দরজা খুলে দেয়।

দুটি অভিযানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি করে এসএসসি ও এইচএসসি সার্টিফিকেট, তিনটি মার্কশিট, সার্টিফিকেটপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের তথ্য সংবলিত তিনটি রেজিস্ট্রারসহ এ সংক্রান্ত নানা ডকুমেন্ট জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা র‌্যাবকে জানায়, জিয়াউর রহমান দীর্ঘদিন ধরে কোচিং বাণিজ্যের আড়ালে সার্টিফিকেট জালিয়াতির ব্যবসা করছে। চক্রের সদস্যরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন যেকোনো বছরের অনার্স, মাস্টার্স, ডিগ্রি পাসের সার্টিফিকেট, সব বোর্ডের এসএসসি ও এইচএসসি পাসের সার্টিফিকেট, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট এবং বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট প্রতিষ্ঠানে ভর্তির দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সরবরাহ করে থাকে। এভাবে তারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথাও স্বীকার করেছে।

পিডিএসও/হেলাল​

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জালিয়াত,টাকা,সনদ,সার্টিফিকেট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close