সীমান্ত প্রধান

  ১০ মে, ২০১৭

গঠনমূলক হওয়াটাই কাম্য

যখন স্কুলে পড়ি, তখন লাইব্রেরি থেকে ‘ফুটন্ত গোলাপ’ নামে একটি উপন্যাস কিনেছিলাম। বইটির লেখক ছিলেন কাসেম বিন আবুবাকার। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনসহ অনেক নামকরা লেখকদের বইয়ের মাঝখান থেকে তার বইটিই তুলে নিয়েছিলাম। অন্যদের বই তো পড়ি, তাহলে তার বই কেন পড়ব না—এমন ভাবনা থেকেই বইটি কেনা।

যদিও ‘ফুটন্ত গোলাপ’ পড়ে শেষ করা হয়নি। মানে, পাঠক হিসেবে আমাকে টানেনি। তবে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে প্রাপ্ততথ্যে আমি হতবাক হয়েছিলাম। তাদের একটি লাইব্রেরি আছে। সে-ই আমাকে জানিয়েছিল, কাসেম বিন আবুবাকারের বই অনেক বিক্রি হয়। তার অসংখ্য পাঠক। তবে পাঠকের বেশির ভাগই অর্ধশিক্ষিত এবং আধুনিক গোত্রবহির্ভূত।

যারা ’৯০ দশকে একাডেমিক বইয়ের বাইরে বিভিন্ন বই পড়া শুরু করেন, তাদের কাসেম বিন আবুবাকারকে চেনার কথা। নামটি সে সময় বেশ পরিচিত ছিল, এটাই সত্য। আজ হয় তো অনেকে স্বীকার করতে চাইবেন না নিজের আধুনিকতার শরীরে ব্ল্যাকস্পট পড়ে যাওয়ার ভয়ে। হঠাৎ করেই কেন জানি আজ ফেসবুকে এই লেখকের নিন্দে করাটা যেন এক ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তার বিরুদ্ধাচরণ করে দু-একটি পোস্ট লিখে নিজেকে গর্বিত প্রগতিশীল হিসেবে জাহির করার এক উদ্ভট প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে অবশ্য লাভবান কাসেম বিন আবুবাকারই। কেননা, এতদিন নির্দিষ্ট একটি পাঠক গোষ্ঠীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন। এখন পুরো দেশব্যাপী তার পরিচিতি। এ আর কম কিসে? সেদিক দিয়ে বলব, তিনি একজন সফল ব্যক্তি, সফল লেখক। কেননা, কোনো লেখককে নিয়ে যদি আলোচনা-সমালোচনা না-ই হবে, তাহলে তিনি সফলতার সিঁড়ি কী করে পার হবেন? আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনা হোক, এটা সবাই চায়। তবে সমালোচনা করতে গিয়ে নিজেই যেন সমালোচনার পাত্র হয়ে না পড়ি।

অনেকেই কাসেম বিন আবুবাকারকে সস্তা, বাজারি এবং চটি লেখক হিসেবেই আখ্যায়িত করছেন। মোদ্দাকথা, নিন্দে হোক আর যাই হোক—তিনি বর্তমানে ‘বহুল আলোচিত’ একজন লেখক। তবে এ কতিৃত্বটা বিদেশি পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি মেইল’-এর। পত্রিকাটি তাকে নিয়ে আর্টিকেল না লিখলে তিনি অন্ধকারেই থেকে যেতেন। আমাদের গণমাধ্যমগুলোও তাকে নিয়ে লিখত না। টিভিগুলো এক্সক্লুসিভ টক শোর আয়োজন করত না। অর্থাৎ সস্তা এই লেখক এখন ব্যবসা বৃদ্ধির খোরাক হয়ে উঠেছেন।

এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে আজ যারাই লিখছেন এবং অতীতে যারাই লিখেছেন, সবাই কিন্তু জনপ্রিয় হতেই লিখেছেন। প্রকাশ্যে হোক আর গোপনে হোক, প্রতিটি লেখকই চান দেশজুড়ে খ্যাতি পেতে। সবাই তাকে চিনুক, জানুক এমনটি কোন্ লেখক চান না? সবাই চান পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে। এক্ষেত্রে কেউ পেরেছেন, কারো অঙ্কুরেই সমাপ্তি ঘটেছে। সেদিক থেকে কাসেম বিন আবুবাকার সফল। কেননা, তার বইয়ের কাটতি ছিল অবাক করার মতো। কোনো কোনো বই লাখও ছাড়িয়ে যেত। সে হিসেবে তার পাঠকশ্রেণির সংখ্যা ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা রয়েছে। শ্রেণিটা উচ্চ, মধ্য কিংবা নিম্ন যাই হোক না কেন, পাঠক তো? এত সংখ্যক পাঠক আর ক’জনই বা পেরেছেন তৈরি করতে, এক হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া?

হতে পারে বোদ্ধামহলের কাছে তার সাহিত্য কোনো পর্যায়েই পড়ে না। হতে পারে সাহিত্যের ‘স’-ও তিনি জানেন না। যার কারণে সেই ’৯০ দশক থেকে লেখা এই লেখককে নিয়ে আমাদের দেশীয় গণমাধ্যম কখনই লেখালেখি করেনি, আলোচনায় আনেনি। তার লেখা, সাহিত্যে আহামরি কিছু নয়। আবার এ-ও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তার বই বিক্রি হয় এবং পাঠকের সংখ্যাও কম নয়। বরং অনেক পপুলার লেখকের চেয়ে অনেক বেশি।


কাসেম বিন আবুবাকার যথেষ্ট পরিমাণেই সার্থক। তিনি তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।

যার কারণে তাকে নিয়ে এএফপি, ডেইলি মেইল, ইয়াহুসহ বেশ কটি বিদেশি পত্রিকা আর্টিকেল ছেপেছে।

সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশীয় মিডিয়াও তাকে নিয়ে টানাটানি করছে


কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তার লেখায় অতিমাত্রায় যৌনতা রয়েছে। যার কারণে সেগুলো সাহিত্য নয়; চটি। কিন্তু কথা হচ্ছে, আদি থেকে অদ্যাবধি যত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে সেসব সাহিত্যে কি যৌনতা আসেনি? প্রেম এবং কাম প্রতিটি মানুষের জীবনেই অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। মানুষের রোজকার জীবনে প্রেম ও কামকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সেদিক থেকে বিচার করলে তিনি যে উপন্যাস লিখেছেন, একটি শ্রেণির মানুষকে পাঠক ভেবেই লিখেছেন। সেই শ্রেণিটা হতে পারে ধর্মভীরু অথবা ধর্মান্ধ। এরা তো প্রেম ও কামের ঊর্ধ্বে নন। তাহলে সমস্যা কোথায়!

বরং তিনি তার লেখায় ধর্মীয় দিকটা তুলে এনে প্রেমের যে প্লট তৈরি করেছেন তা রক্ষণশীল পরিবারের মধ্যেও ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। এ ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, তিনি একটি রক্ষণশীল পরিবারের দেয়াল ভেঙে অন্দরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। রক্ষণশীল পরিবারের মাঝেও যৌনতানির্ভর বই ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। কেননা, অনেকেই মনে করতেন তার লেখায় যেহেতু ধর্মীয় দিকগুলো রয়েছে সেক্ষেত্রে তার বই পড়া যেতে পারে, ঘরে রাখা যেতে পারে কিংবা বাজার থেকে কেনাও যেতে পারে। এটাই বা কম কিসের?

তার সাক্ষাৎকার থেকে যতটুকু জানা গেছে, তিনি যে শ্রেণিকে লক্ষ করে উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন, সে শ্রেণির কাছে তিনি ঠিকই পৌঁছে গেছেন। সুতরাং তিনি তার লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছাতে পেরেছেন। পাঠকের একটি অংশকে তিনি তার লেখার মাধ্যমে আটকে রাখতে পেরেছেন। যা অনেক লেখকই করতে পারেননি।

অনেকেই বলেন, তার সস্তা লেখার সস্তা পাঠক! ঠিক কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে তার লেখা বই টাকা খরচ করে যারা কিনে নিয়ে সময় ব্যয় করে পড়ছেন, তারা তো এই সমাজেরই অংশ, তাদের কি সমাজ থেকে আলাদা করা যাবে? ড্রয়িং রুমে বসে সমাজ দেখার মধ্যে পুরো বাংলাদেশকে পাওয়া সম্ভব নয়। এর বাইরেও বাংলাদেশ আছে। তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মার্জিত সাহিত্য তৈরি হোক—এটা সবারই চাওয়া। যারা হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ পড়েন না, তারা কিন্তু কাসেম বিন আবুবাকার পড়েছেন।

আমাদের অত্যাধুনিক নতুন প্রজন্ম যাকে নিয়ে এত মাতম করছে কিংবা শুধু নতুন প্রজন্মই নয়; প্রগতিশীল চেতনায় বিশ্বাসীরা তার সমালোচনা করে লাইনের পর লাইন লিখে ফেলেছেন, সেটা কেন? বিদেশি পত্রিকা তাকে নিয়ে লিখে সত্য প্রকাশ করেছে, এজন্যই কি গাত্রদাহ? এটা কী হিংসা নাকি হীনম্মন্যতা? সম্ভবত এ দুটো থেকেই গাত্রদাহ এবং তাকে নিয়ে হইচই। তবে এর সঙ্গে আরেকটি ব্যাপারও যুক্ত করা যায়। সেটি হলো, নিজেকে সচেতন ও প্রজ্ঞাবান, প্রগতিশীল পাঠক হিসেবে জাহির করতে কেউ কেউ তাকে নিয়ে সমালোচনা করছেন।

এ ক্ষেত্রে বলা যায়, কাসেম বিন আবুবাকার যথেষ্ট পরিমাণেই সার্থক। তিনি তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। যার কারণে তাকে নিয়ে ‘এএফপি’, ‘ডেইলি মেইল’, ‘ইয়াহু’সহ বেশ কটি বিদেশি পত্রিকা আর্টিকেল ছেপেছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশীয় মিডিয়াও তাকে নিয়ে টানাটানি করছে। সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য ছুটে যাচ্ছে তার কাছে। তারা কেন যাচ্ছে কাসেম বিন আবুবাকারের কাছে? পাঠক চাহিদার কথা বিবেচনা করে? তাহলে এই বাকার যা লিখেছেন সেটিও তো পাঠক চাহিদার কথা বিবেচনায় লেখা। তাহলে অন্যরা বাজারি না হলে এই বাকারকেই বা কেন বাজারি বলে গাল দেয়া হচ্ছে! যারা গালমন্দে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন পণ্যকে বাজারজাত করার আগে একবার বিপণনটা দেখে নিন। এখানে মনে রাখা খুবই জরুরি যে, বিশ্ব বই বাজারে সর্বাধিক বিক্রির তালিকার মধ্যে একটির নাম, ‘দ্য অ্যারাবিয়ান নাইটস্’—যার বেশির ভাগ গল্পই সেক্সনির্ভর।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ফুটন্ত গোলাপ,কাসেম বিন আবুবাকার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist