আরিফ ইকবাল হোসেন

  ০৬ নভেম্বর, ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ব্যাংক পরিবার

ওরাল হিস্ট্রি বা মৌখিক ইতিহাস চর্চার ধারায় প্রভাবিত হয়ে গত একযুগ ধরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় যে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে, এরই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ে (১৯ আগস্ট ২০১৯) প্রকাশিত ‘অগ্রণী ব্যাংক পরিবার : মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা’ গ্রন্থটি। বইটির নির্দেশনায় রয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বঙ্গবন্ধু কর্নারের উদ্ভাবক মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম এবং সম্পাদনা করেছেন উপমহাব্যবস্থাপক মো. আবু হাসান তালুকদার।

গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ও কম্পোজের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ফিরোজ আহাম্মেদ ও মো. শাহেদুল ইসলাম। সংশ্লিষ্ট গ্রন্থটির উপজীব্য বিষয়, ৭১ জুড়ে অগ্রণী ব্যাংক পরিবারের শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ ও অনবদ্য সংগ্রামের কথা। খণ্ড খণ্ড ব্যক্তিক ইতিহাসের উপাদানসমূহ গ্রন্থটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসে পরিণত করেছে, আর সে ইতিহাস আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

গ্রন্থটি কতটা বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে সম্পাদনা করা হয়েছে এর একটি উদাহরণ হতে পারে, গ্রন্থ সম্পাদক কর্মরত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অংশের তথ্য সন্নিবেশনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শী পরিবারের সদস্যদের মৌখিক সাক্ষাৎকার নিতে স্বশরীরে ছুটে গিয়েছেন। ‘অবরুদ্ধ দিনগুলি’ শিরোনামের অংশটিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত পরিবারের এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে একাত্তরে তাদের পরিবারকে কি নির্মম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে; তাও প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।

গ্রন্থটি একদিকে যেমন সিদ্দিকুর রহমান, আবু হোসেন সিদ্দিকী ও মো. আবদুল হামিদের মতো সম্মুখযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা চিত্রিত করেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ ফোর্সেস হাসপাতালে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত (চিকিৎসাকর্মী) এ জেড এম সাদেকুর রহমান এবং ম. ফ. করিমের মতো ভিত্তি যোদ্ধার অবদানকে আমলে নিয়েছে। তৎকালীন হাবীব ব্যাংকের (বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক) পীরগাছা শাখার ব্যবস্থাপক শাহজাহান মন্টুর মতো ব্যাংকারের ব্যাংকিং মূল্যবোধ ও সততার বিষয়টিও স্থান পেয়েছে।

গ্রন্থ সম্পাদক কোনো স্বীকৃত ইতিহাস গবেষক না হলেও যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার সঙ্গে গবেষণা কর্মটি সম্পাদনা করেছেন। গবেষণার প্রয়োজনে শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও তাকে ছুটে যেতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে, নিতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার ও লিখিত দিনলিপি।

গ্রন্থ সম্পাদকের মতে, ২০১১ সাল পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকে যাচাইকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২৫৬ জন, এদের অনেকে মৃত ও অবসরে চলে গেছেন বিধায় সবার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। গ্রন্থে উল্লেখিত ১৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিক ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাদের/তাদের পরিবারের বক্তব্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়েছে, কেননা এদের অনেকেই পূর্ববর্তী কোনো লেখক কিংবা গবেষকের আলোচনায় আসেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের প্রদানকৃত বর্ণনা যাচাইয়ের সুবিধার্তে মুক্তিযুদ্ধের উপর লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থ, জাতীয় আর্কাইভসের তথ্য, পত্র-পত্রিকার লেখা, বিভিন্ন কলাম, যুদ্ধকালীন দস্তাবেজ্ ইত্যাদি থেকে যুদ্ধের বর্ণনা ও সম্ভব হলে তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট গ্রন্থটিতে ‘ওরাল হিস্ট্রি’ বা মৌখিক ইতিহাসের উপাদানের আধিক্যের কারণে একদিকে যেমন ইতিহাস রচনার নতুন নতুন উপাদান সংযোজিত হয়েছে, অন্যদিকে কিছু সীমাবদ্ধতারও ইঙ্গিত দিয়েছে। যেমন, স্মৃতি বিভ্রাট হওয়া মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হকের ক্ষেত্রে তার সহযোদ্ধাদের পরিবর্তে পারিবারিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ, আবার মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী মিয়ার ক্ষেত্রে দুধচুরি মাইনিমুখ মারিশ্যার যুদ্ধের (রেকর্ডে দুরছরি বাজারের যুদ্ধ) অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা। তবে কোনো স্বীকৃত ইতিহাসবিদের প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে, সংশ্লিষ্ট গ্রন্থে প্রদানকৃত তথ্যে যদি অসংগতি থেকে থাকে, সেজন্য গ্রন্থ সম্পাদক দুঃখও প্রকাশ করেছেন।

আরপি বাংলা কমিউনেকেশন্স প্রকাশিত ৮৭৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি যদিও স্মৃতিকথা তবু, ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের ধারা ও সন্নিবেশন গ্রন্থটিকে একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থে পরিণত করেছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অগ্রণী ব্যাংক,মুক্তিযুদ্ধ,গবেষণা,গ্রন্থ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close