reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৮ মার্চ, ২০২৩

‘কর্মক্ষেত্রে নারীর অনেক বাধা আছে’

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে দায়িত্ব পালন করেছেন সমাজবিজ্ঞান ও আইন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় সভাপতি, সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্য, বিশ্ববিদালয়ের নারী নিপীড়ন বিরোধী সেলের প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে। মঙ্গলবার একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেছেন নারী দিবসের তাৎপর্য, নারী প্রতি সহিংসতা ও ব্যক্তি জীবনের নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতিদিনের সংবাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি তহিদুল ইসলাম

প্রতিদিনের সংবাদ: নারী দিবসকে কেন্দ্র করে আপনার ভাবনা কী?

অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার: বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকের আন্দোলনের ভিত্তিতেই নারী দিবস ৮ মার্চ তৈরি হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে যদি বলি ভাবনাটা ওরকম যে, আমরা যে নারী আছি, নারীর যে অধিকার আছে এবং নারীকে যে সম্মান দিতে হবে, প্রতিটি দেশেই নারীর এ বিষয়টি সামনে আনা প্রয়োজন। কারণ অনেক সময় আমরা কিন্তু নারীকে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখি। ফলে সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, নারী দিবসের অবশ্যই একটা তাৎপর্য আছে। এবং এটা যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, সারা বিশ্ব একই দিনে এটাকে পালন করে। আন্তর্জাতিকভাবে একটা প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। বিভিন্ন দেশ হয়তো তার মতো করে কিছু বদল করে। ফলে তাৎপর্যের দিক থেকে আমি বলব যে, এটা আসলে প্রয়োজন আছে। অন্তত একটু জানান দেয়া যে, আমাদের অস্তিত্ব আছে, আমরা আছি।

প্রতিদিনের সংবাদ: প্রায় প্রতিদিনই নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে আসছে। তবে কী নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে? আপনি কী মনে করেন?

অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার: বাড়ছে কিনা সেটা বলা মুশকিল। জনসংখ্যা বেড়েছে সে হিসেবে সহিংসতা বাড়বে এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হচ্ছে; আগে তো ডিজিটাল যুগ ছিল না। ঘরে ঘরে সহিংসতার খবর পত্রিকার পাতায় আসতো না এবং সেটা কেউ জানতো না। এখন যেহেতু ডিজিটাল যুগে পত্র-পত্রিকা, মোবাইল, ইন্টারনেট সবকিছুর মধ্য দিয়ে বিষয়গুলো প্রকাশ পাচ্ছে, তখন বিষয়গুলো সামনে আসছে। সে হিসেবে দেখা যাচ্ছে সহিংসতা বেড়েছে কিন্তু আগে ছিল না- সেটা বলা যাবে না।

প্রতিদিনের সংবাদ: শিক্ষাকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন কেন?

অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার: আমি যখন স্কুলে পড়ি, পাশ করার জন্য প্রচুর অংক করতে হতো। যেহেতু অংকে ভয় পেতাম, আমার আব্বা সব সময় বলতেন সায়েন্সে যাওয়া যাবে না। আমার ভাই-বোন ও আমার খালাতো ভাই-বোনরা সবাই সায়েন্সে ছিল। আমিই দুই সাইড থেকে প্রথম আর্টসে এসেছি। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন সেভাবে পড়তাম না। কারণ, আমাকে বলা হতো, আর্টসে গেলে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া যায় না। আমি ভাবতাম যেহেতু ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া যাবে না, তাহলে এত সিরিয়াসলি পড়ে লাভ কি। তখন আমি সিলেটে ছিলাম। ওই সময় আমাদের কলোনিতে এক মেয়ে অন্য স্কুলে পড়তো। সে আর্টসে ছিল। একদিন আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে। তার সাথে কথা হচ্ছে, আমি বললাম আমি সেভাবে পড়ি টড়ি না। পড়লেই তো পাশ করি। আবার স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ডও হয়ে যাই। আর আমি তো জানি বোর্ডে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া যাবে না। তখন সে বলল, সে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ার জন্য সিরিয়াসলি পড়ছে। এরপর আমি ক্লাস টেনে উঠে সিরিয়াসলি পড়া শুরু করলাম। মেট্রিকে ভালো করলাম। আমি যখন বোর্ডে স্ট্যান্ড করলাম, তখন আমি অন্যভাবে চিন্তা করা শুরু করলাম। এরপর ইন্টারমিডিয়েট গেল। ইউনিভার্সিটিতে যখন ভর্তি হই, তখন আমার মনে হয়েছে; আমি যদি রেজাল্ট ভালো করি আমি শিক্ষাকতায় যাব। আমার ভিশনটা ওইখান থেকেই তৈরি হয়।

প্রতিদিনের সংবাদ: বর্তমানে আপনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এতদূর আসবেন ভেবেছিলেন কখনো?

অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা জীবনের প্রথম দিনগুলোতে আমি ভাবিনি আমি রাজনীতিতে ঢুকবো। আমি নৃবিজ্ঞান বিভাগের এডহকে জয়েন করেছি। লেকচারার তো কম থাকে। আমাদের সময় মেয়ে লেকচারার কমই ছিল। আমাদের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলরের ব্যাচের পরে মেয়ে কিন্তু ছিল না। এখন যেমন প্রতিটা ডিপার্টমেন্টে মেয়ে কলিগ আছে আমাদের তখন কিন্তু একটা গ্যাপ ছিল। লেকচারার অবস্থাতে আমি সিন্ডিকেট মেম্বার ছিলাম। সিন্ডিকেট মেম্বার হওয়ার পরে যখন আমি কাজ করছি তখন অনেক কিছু বুঝে বলতাম, আবার অনেক কিছু না বুঝে বলতাম। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় কোন মেকানিজমে চলে সে ধারণা লেকচারার অবস্থায় আমার ছিল না। মিটিংয়ে দেখা যেত, সবাই এক স্রোতে কথা বলে আমি আরেক স্রোতে বলি। আমার কাছে যেটা ন্যায্য মনে হয়। এমন করতে করতে আমি ভাবলাম এটা তো আর এভাবে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতে গেলে একটা লেবেলে গিয়ে করতে হয়। এটা সিনিয়র হয়ে করলে ভালো। একদিয়ে হয়েছি নারী। অনেক বাঁধা আসে। অনেক রকমের কথা ওঠে। অনেক রকমের সমস্যা। সেটা ফেস করেছি। আমার তেমন সমস্যা হয়নি। অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর হওয়ার পরে আমাদের ডিপার্টমেন্ট যেহেতু নতুন ছিল কয়েকজন বাইরে চলে গেল। ফলে অল্প বয়সে সভাপতির দায়িত্ব নিতে হলো। সভাপতিত্ত্বও সফলভাবে চালাতে পেরেছি। সমস্যা হয়নি। স্ট্রাগল তো কিছু করতেই হয়। সেটা যেকোন কাজের ক্ষেত্রেই আছে। তারপর একটা গ্যাপ দিলাম। গ্যাপ দিয়ে আমি রাজনীতিতে ঢুকলাম। সিনেট ইলেকশন করলাম ২০০৯ সালে। সেখানে জিতলাম। ওই শুরু হলো। তখন ওইভাবে ধাপে ধাপে ট্রেজারার, প্রো-ভিসি, ভিসি হবো এটা মনে হয়নি। সে সময় বয়স সবকিছু মিলিয়ে মনে হত এটা তো অনেক বড় জায়গা। তারপর যখন এটার ভেতরে ঢুকলাম, তখন মনে হলো যে, না আমি যদি আমার কাজ দিয়ে চেষ্টা করি তাহলে তো আমি করতে পারি। আর আমাদের সমাজে আমরা এখনো যতকিছু বলি না কেন: আমাদের সমাজ বলো বা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বলো, যতই নারী বান্ধব হোক না কেন তারপরও কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মত কোন পুরুষ কলিগ ওইভাবে চায় না যে, কোন নারী নির্বিগারে কোন জায়গায় যাক। প্রকাশ্যে না বললেও এক ধরণের স্নায়ু চাপ কিন্তু থাকেই। নারীকে ওই পদে দেখতে চায় না। এ বিষয়গুলো কিন্তু এখনো আছে। তারপরও এর ভেতর দিয়েই সার্ভাইব করতে হয়। এটা হলো বিষয়।

প্রতিদিনের সংবাদ: আপনার অগ্রযাত্রায় পরিবারের সহযোগিতা কেমন ছিল?

অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার: আমরা যখন বড় হয়েছি তখন তো আমাদের ওদিকে পড়ালেখা কেউ তেমন করতো না। বিশেষ করে মেয়েরা। কিন্তু আব্বার ফিলোসোফিটা ছিল এরকম যে, মেয়েরা আগে নিজের পায়ে দাড়াবে তারপর বিয়ে সাদি করবে। আমাদের এটা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা ছিল না যে, আমাদেরকে পড়াবে না বা এরকম কিছু। আমার ইমিডিয়েট বড় বোন যখন মেট্রিক পরীক্ষা দিল। তখন আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে আমার দাদা ভাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো। আব্বা তখন বললো, আমার মেয়েরা সবগুলোই ভালো রেজাল্ট করতেছে। আমি যদি মেয়েগুলোকে না পড়াই আমার ক্ষতি না কিন্তু দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। আমাদের কোন সমস্যা ফেস করতে হয়নি। যখনই এরকম কোন সমস্যা এসেছে দেখা গেছে, আব্বাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ছয় ভাই-বোনকে আব্বা একইভাবে ট্রিট করতো। বরং আব্বা বলতো মেয়েদেরকে বেশি প্রায়োরিটি দিতে হবে কারণ ওরা পরের বাড়ি যাবে। কোন পরিবেশে যাবে, সেখানে সে যেটা চায় সেটা সে নাও পেতে পারে। তার চাওয়া পাওয়া বাবার বাড়িতেই পূরণ করতে হবে। ফলে আমাদের জন্য পরিবারে কোন বাধা ছিল না।

প্রতিদিনের সংবাদ: আপনি কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজ বিভাগে ক্লাস নেন। দুইটি ভিন্নধর্মী দায়িত্ব একই সঙ্গে কীভাবে সামলাচ্ছেন?

অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার: প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে একটা বাধ্যবাধকতা আছে। ক্লাসের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আছে যে, রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নেওয়া। কিন্তু সেখানে একটা ফ্লেক্সেবিলিটি আছে যে, ক্লাস এই টাইমে নেব না, ওই টাইমে নে। সেটা স্টুডেন্টদের সাফার করা হয়। এভাবে এডজাস্ট করা হয়। যেহেতু একটা কোর্স করাচ্ছি, প্রত্যেকদিন ক্লাস থাকে না। সপ্তাহে হয়তো দুইটা ক্লাস থাকে। কোন সপ্তাহে হয়তো ক্লাস নিতেই পারি না। কোন সপ্তাহে হয়তো একটা নেই। কলিগরাও সহযোগিতা করে। পরীক্ষাগুলো নিয়ে দেয়। এভাবেই এডজাস্ট করছি। তবে আমার মনে হয় না আমি আর সামনের বছর নিতে পারব। কিন্তু আমি শিক্ষকতা কাজের ক্ষেত্রেই বেশি আরাম পাই। ক্লাসে গেলে একটা অন্যরকম অনুভূতি থাকে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কর্মক্ষেত্র,নারী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close