ইকবাল হোসেন রুবেল, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

তীর্থযাত্রীদের কয়েকগুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে পূজার সরঞ্জাম ও খাদ্যসামগ্রী 

শিবচতুর্দশী মেলায় ব্যাপক চাঁদাবাজি

মেলায় দোকান ও পুরোহিতদের কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা আদায় 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ ধামে শিবচতুর্দশী মেলার তৃতীয় দিন রবিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। এদিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দর্শনার্থীর ‘বোম ভোলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে তীর্থধাম। এদিকে এ মেলাকে ঘিরে ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়েছে। মেলায় আগত পাঁচ শতাধিক দোকান ও ব্যাসকুণ্ডের পাড়ে পূজা-শ্রাদ্ধ-তর্পণ করতে আসা ২৫০ পুরোহিতের কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায়ের তথ্য মিলেছে। কমিটিকে টাকা দিতে হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা জানালেও এভাবে টাকা আদায়ের কথা অস্বীকার করেছেন মেলা ও তীর্থ কমিটির নেতারা।

সরেজমিন মহাতীর্থ চন্দ্রনাথ ধাম এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এদিন সীতাকুণ্ড তীর্থধাম লাখো ভক্তের পদভারে মুখরিত ছিল। ভক্তরা বাবা মহাদেবের সন্তুষ্টির জন্য ‘বোম ভোলা’ হর হর মহাদেব ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে সমতল ভূমি থেকে সাড়ে ৩ কিমি. উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির দর্শনের জন্য যাচ্ছেন। তীর্থযাত্রী, দোকানি, পুরোহিত এবং সনাতনী বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের মেলাকে ঘিরে একটি মহল ব্যাপক চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়েছে। মেলায় আগত প্রতিটি দোকান থেকে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা (চার দিনের জন্য) আদায় করা হচ্ছে। এ চাঁদাবাজির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ব্যাসকুন্ডের পাড়ে পূজা করতে আসা পুরোহিতরাও। প্রত্যেক পুরোহিতকে আড়াই হাত জায়গায় বসার অনুমতি দিয়ে মেলার তিন দিনের জন্য আদায় করা হচ্ছে জনপ্রতি ২ থেকে ৫ হাজার টাকা। এভাবে ৫ শতাধিক দোকান ও ২৫০ পুরোহিতের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্ধকোটি টাকারও বেশি। এছাড়া মেলার বিভিন্ন স্থানে তীর্থযাত্রীদের জিম্মি করে ব্যাগ, স্বর্ণালঙ্কার প্রভৃতি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলেও জানা গেছে। পরিদর্শনকালে কথা হয় সিলেট থেকে আসা ষাটোর্ধ্ব প্রভা রানী ও সোনাপুর থেকে আসা বৃদ্ধা মায়া রানী সূত্রধরের। প্রভা রানী বলেন, জীবনের একটা বড় ইচ্ছা ছিল সীতাকুণ্ডের শিবচতুর্দশী মেলায় আসব। অবশেষে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে পথে পথে শুধু হয়রানির শিকার হলাম। গাড়ি থেকে নেমে একটি ডাব কিনেছি ১২০ টাকা দিয়ে। এই ডাবের দাম ৪০-৫০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। পূজার জন্য প্লাস্টিকের শাখা কিনলাম জোড়া ৪০০ টাকায়। যা বাজারে খুব বেশি হলে ১৫০ টাকা হতে পারে। এভাবে ব্যাসকুন্ডের পাড়ে পুরোহিতের কাছে গেলাম কিছু ধর্মীয় কাজ করতে। তিনি দাবি করেন ৭০০ টাকা। সবখানেই এ রকম অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আমরা দিশাহারা। অন্যদিকে তীর্থযাত্রী মায়া রানী জানান, এ মেলায় এসে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। এক যুবক হঠাৎ করে তার ব্যাগ টান দিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে যায়। এদিকে কেন এভাবে সর্বত্র অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দোকানিদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এখানে দোকান বসালেই অনেক টাকা দিতে হয়। চন্দ্রনাথ ধামের মোহন্ত আস্তানার পাশে বসা টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী দেবদুলাল জানান, মেলার তিন দিনের জন্য ছোট একটি দোকান করতে তাকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। মেলা কমিটির নাম দিয়ে কিছু যুবক এই টাকা জোরপূর্বক দিতে বাধ্য করেন। টাকা না দিলে দোকানের মালামালও তারা লুট করে। এভাবে অতিরিক্ত টাকা দিতে হওয়ায় তারাও ক্রেতাদের কাছে অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করেন। ব্যাসকুন্ডের পাড়ে বসা পুরোহিত নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে আসা প্রলয় ভূষণ চক্রবর্তী ও চাঁদপুরের কচুয়া থেকে আসা শুভাশিষ চক্রবর্তী জানান, তারা এখানে ভক্তদের পূজা করিয়ে দিতে বসেন। এজন্য কমিটির নামে তাদের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। ফলে তারাও ভক্তদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে হচ্ছে। এখানে অন্তত ২৫০ পুরোহিত এভাবে চাঁদা দিচ্ছে বলে জানান তারা। অন্যদিকে মেলায় মহাশ্মশানে গিয়েও দেখা যায় সেখানে প্রকাশ্যে গাঁজা, ভাং বিক্রি ও খাওয়া হচ্ছে। যা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

এদিকে মেলা থেকে অর্ধকোটি টাকারও বেশি আদায় হলেও এসবের দায় নিতে রাজি না রাজ মেলা ও ¯্রাইন কমিটি। এসব বিষয়ে মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা বলেন, আমরা কোনো টাকা তুলি না। দোকানপাট বা অন্যান্য ইজারার টাকা তোলে ¯্রাইন (তীর্থ কমিটি)। তারা আমাদের মেলার খরচের জন্য মাত্র আড়াই লাখ টাকা দেন। আমাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মিথ্যা। অন্যদিকে তীর্থ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট চন্দন দাস বলেন, পুরোহিতদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আমি গত বছরও প্রতিবাদ করেছি। কেন পুরোহিতরা পূজা করতে এসে চাঁদা দেবে? কিন্তু তবু একটি মহল জোর করে চাঁদা আদায় করছে। আর দোকানপাটের জায়গাও আমরা ইজারা দিই না। স্থানীয় ভোলার নেতৃত্বে ৩-৪ জন এসব ইজারা দেওয়া, টাকা তোলা এসব করেন। কিন্তু দায় আসে আমাদের ওপর।

চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ (বিপিএম) এসব বিষয়ে বলেন, এখানে চাঁদাবাজির কারণে দূরাগত তীর্থযাত্রীরা হয়রানির শিকার হলে বদনাম হবে। তাই এসব বন্ধ করব আমরা। তিনি সীতাকুণ্ড থানার ওসিকে এসব চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সীতাকুণ্ড
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close