বলরাম দাশ অনুপম, কক্সবাজার

  ২০ নভেম্বর, ২০২২

উপকূলে জীবনযুদ্ধ, প্রতি বছর সাগরে বিলীন হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ বাড়ি

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

বিধ্বস্ত বাঁধে পলিথিনে মোড়ানো ঝুঁপড়ি ঘর। জোয়ারের তোড়ে সেই ঘরের অর্ধেক বিলীন সাগরে। যেটুকু আছে সেখানেই টিকে থাকার সংগ্রামে পয়ত্রিশোর্ধ্ব খতিজা বেগম। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে এ নারীর দু’চোখ পশ্চিমের সাগর থেকেই সরছে না। কাছে যেতেই ভারী গলায় বলে উঠলেন, ‘কী জীবন কাটাবো এখানে? সাগরের সাথে কি পেরে উঠবো আমরা? আলাপকালে খতিজা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীর ভিটেবাড়ি ছিল। ১৮ বছরের ভাঙা-গড়ার জীবনে সবকিছুই সাগরে বিলীন হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭ বার ঘর বেঁধেছি, কিন্তু বছর ঘুরতেই নিঃস্ব হই। তার ওপর সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। জমি-জমাও নেই। বাঁধই এখন আমাদের শেষ ঠিকানা।’ এ নারীর পৈত্রিক নিবাস কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল। দেড়যুগ পূর্বে মহেশখালীর মাতারবাড়ির মৃত আবদুল করিমের পুত্র জসিম উদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। সেই সুবাদে বাস করেন ষাইটপাড়ায়।

খতিজার ঝুঁপড়ি ঘরের লাগোয়া স্বামী ও দুসন্তান নিয়ে থাকেন কোহিনূর আক্তার। সেও দিলো দুর্বিষহ এক রাতের বর্ণনা। কোহিনুর স্মৃতিচাররণ করে বলেন, ‘সেদিন ছিল ভরা অমাবশ্যা। পলিথিন মোড়ানো ছনের চাউনির ঘরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে। আমার স্বামী আবদুল মোনাফ ছিলেন না। এক বছর বয়সী সন্তান রবিউল হোসাইনকে নিয়ে অনেক ভয়ে ছিলাম। পরবর্তীতে আমার চিৎকার শুনে পাশ্ববর্তী বাসিন্দারা এগিয়ে আসেন। এরপর চাল কেটে আমাকে উদ্ধার করে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘পরদিন সকালে এসে দেখি সহায় সম্পদ ও ঘর পানিতে ভেসে গেছে। এরপর থেকে পরের বাড়িতে আশ্রয়ে আছি। রাত হলে এখনও ভয়ে বুক কাঁপে।’পাশ্ববর্তী জরবাহারুর (৫৫) এর আক্ষেপ, ‘ঘরের কষ্টে খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা। কবে যে এই সাগর মুক্তি দেবে সেই চিন্তায় দিন কাটছে।’ এ-তো গেল মাতারবাড়ির ষাইটপাড়ার চিত্র। পাশ্ববর্তী ধলঘাটার অবস্থা নাজুক।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেছেন, ‘ভাঙনের কবলে পড়ে এখানকার সরাইতলা গ্রামটি একবারেই সাগরগর্ভে চলে গেছে। এছাড়া জনবসতি, সরকারি স্থাপনা ভেসে গেছে পানিতে। ভাঙতে ভাঙতে বেড়িবাঁধ লাগোয়া এখন মাত্র ১৫টি ঘর রয়েছে। অন্যদিকে পাউবো’র বাঁধে বাস করছে ৪৫টি পরিবার। যেগুলো ঝুঁকিতে।

সরাইতলার মরিয়ম খাতুন (৬৪) বলেন, ‘৬ বছরে ১০ বার ঘর বেঁধেও টিকতে পারিনি। বর্ষায় অনত্র সরে যাই, পানি নেমে গেলে চলে আসি। এভাবে চলছে জীবন।’ তিনি পশ্চিমের সাগরের দিকে আঙ্গুলের ইশারা দিয়ে আরও বলেন, ‘ঐ-যে দেখছেন সাগর, সেখানে আমার দুই কানি জমির ভিটেবাড়ি ছিল।’

এ এলাকার নুর বেগম বলেন, ‘পলিথিনের ওপর ইট আর প্লাস্টিকের বস্তা মুড়িয়ে কোনমতে টিকে আছি।’

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শুধু খতিজা, কোহিনূর কিংবা মরিয়ম খাতুনই নন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মাতারবাড়ি-ধলঘাটার প্রতিটি মানুষের মন বিষণ্নতায় ভরে উঠে। কিন্তু দীর্ঘদিনের দাবি, ‘টেকসই বাঁধ’ আর ‘স্থায়ী ঘরের’ স্বপ্ন পূরণ হয় না। স্থানীয়রা জানিয়েছে, প্রতি বছর ৮০ থেকে ১০০টি বাড়ি সাগরে বিলীন হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, ১৯৯১ সালের প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী দুই ইউনিয়ন থেকে কয়েক হাজার পরিবার উদ্বাস্তু হয়েছেন। এসব পরিবার কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, চকরিয়া, লামা, আলীকদম, শাপলাপুর, কালারমারছড়ার পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়েছেন। যারা এখনো রয়ে গেছেন তাদের রক্ষায় বাঁধ ও ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়নি কেউ। অপরদিকে সাময়িকভাবে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে ভাঙন ঠেকাতে জিওব্যাগ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করা হলেও সেখানেও চলে অনিয়ম।

মাতারবাড়ির ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সরওয়ার কামাল বলেন, ‘ষাইটপাড়া ও জালিয়াপাড়া সংলগ্ন বাঁধে ৮০০ পরিবারের বাস। এদের কারো স্থায়ী ঠিকানা নেই। তারা ঘন ঘন ভাঙনের কবলে পড়েন। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে নয়াপাড়া পয়েন্টের বাঁধ ভেঙ্গে ৩০টি বাড়ি বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি ৩শ একর জমিনের আমন ধান লোনা পানিতে নষ্ট হয়েছে।’

এর আগেও জালিয়াপাড়ার ১৭টি, পরবর্তীতে পূর্ণিমার জোয়ারে ১৫টি ও সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে ৩০টি বাড়ি বিলীন হয়েছে বলে জানান এ জনপ্রতিনিধি। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়িতে বেড়িবাঁধ রয়েছে ৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিতে দেড় কিলোমিটার। ঝুঁকিপূর্ণ এ বাঁধের ৯০০ মিটার সংস্কারে গত এপ্রিলে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮ প্যাকেজে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁধ সংস্কার করে পাউবো’কে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু কাজ বুঝিয়ে দেয়ার ১২ দিনের মাথায় পূর্ণিমার জোয়ারে ৪০০ মিটার বাঁধ ধসে পড়ে। এরপর কোরবানির ঈদের তিনদিন আগে অবশিষ্ট অংশও ভেঙ্গে পড়ে।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. ছাদেক (২৭) বলেন, ‘ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো গাইডওয়াল ভেঙে বাঁধের নিচ থেকে বালি উত্তোলন করে জিওব্যাগ বসিয়েছিল। যার কারণে জোয়ারের তোড়ে বাঁধ ধসে গেছে।’ ষাটোর্ধ্ব কবির আহমদের মতে, ‘বালির বাধ দিয়ে এখানে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বাঁধ নির্মাণের সময় প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু কথা শুনেনি। তাদের অবহেলায় আমাদের জীবন ঝুঁকিতে।’ মেহেদী হাসান, রুকন উদ্দিন বলেন, ‘যতকাল টিকে থাকতে পারি থাকবো, না পারলে চলে যাব। এখানে থাকা মানে জীবন নিয়ে খেলা।’

মাতারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এসএম আবু হায়দার বলেন, ‘বাঁধে বসবাসকারী ৫০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য তালিকা ও জমিও নির্ধারণ হয়েছে। শীঘ্রই কার্যক্রম শুরু হবে।’

ধলঘাটার ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, ‘ইউনিয়নে ৮কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে সাপমারার ডেইলের কিছু অংশে জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে পাউবো। তবে সরাইতলার ২ কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া কুহেলিয়া চ্যানেলের উলাখালী ঘোনা থেকে সাপমারার ডেইল পর্যন্ত ১ কিলোমিটারও ঝুঁকিতে।’

ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, ‘টেকসই বাঁধ নির্মাণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিবার জানিয়েছে। কিন্তু তারা আশ্বস্ত করে, উদ্যোগ নেয় না। ফলে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। সরকার সুপার ডাইক বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা বলছে। আমরা সেটির দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। পাশাপাশি বাঁধে বসবাসরতদের পুনর্বাসনে উর্ধ্বতন মহলে আবেদন করেছি।’

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয়দের রক্ষায় ঠিকাদার নিয়োগ করে ভাঙনকৃত বাঁধ পুনরায় সংস্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি মাতারবাড়ি-ধলঘাটায় ২৮শত ৪৬ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৭.৭৫ কিলোমিটার টেকসই সুপার ডাইক বাঁধ নির্মাণে নকশা উর্ধ্বতন কতৃর্পক্ষের অনুমোদনের অপেক্ষায়।’

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
উপকূলে জীবনযুদ্ধ,বিলীন হচ্ছে বাড়ি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close