নড়িয়া (শরীয়তপুর) প্রতিনিধি

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

এখনও ভাঙছে নড়িয়া

কয়েকদিনের ব্যবধানে ভিটা হারা আরও ৬৫ পরিবার

শরীয়তপুরের নড়িয়ায় আজও পদ্মার ভাঙণ অব্যাহত রয়েছে। কয়েক দিনে পদ্মার আগ্রাসী থাবায় ভিটা বাড়ি হারা হয়েছে ৬৫ পরিবার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন কেদারপুর ইউনিয়নের জব্বার খানের দুই মেয়ে সালমা খান ও আসমা খানের তিন তলা একটি পাকা ভবন মঙ্গলবার দুপুর ২টার সময় হঠাৎ করে দুমড়ে মুচড়ে নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। এই নিয়ে গত দুই দিনে আবারও নদী গর্ভে বিলিন হলো আরো ৬৫ পরিবার। তবে পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি ও স্রোত কম থাকায় ভাঙনের তীব্রতা কয়েক দিন আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। স্থানীয়রা জানায়, পানি কমতে শুরু করলে আবারও ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে।

কয়েক দিনের ভাঙনে শুভগ্রাম, বাঁশতলা, দাস পাড়া, পূর্ব নড়িয়া ও উত্তর কেদারপুর গ্রামের ৬৫টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। এ নিয়ে গত তিন মাসে পদ্মার ভাঙনে নড়িয়ার তিনটি ইউনিয়নে ও পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডে প্রায় ছয় হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। কয়েক হাজার একর কৃষি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি প্রশাসন।

এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তিনটি খনন যন্ত্র দিয়ে সোমবার থেকে নড়িয়ায় চর কেটে নদী খননের কাজ শুরু করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি খনন কাজ। ড্রেজার দিয়ে চর খনন করে পদ্মার স্রোত দক্ষিণ তীর হতে মাঝে নেয়ার চেষ্টায় এই ড্রেজিং। তাতে যদি নদী ভাঙণ কিছুটা নিরশন হয়। দেরিতে নদী খনন কাজ শুরু হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, চলছে নদীর গভীরতা মাপা ও স্রোতের গতিপথসহ জরীপের কাজ। এই সার্ভেটা না করলে আসলে আমরা কোন লাইনে ড্রেজিংটা করবো তা নির্ণয় করা যাবে না। এই মূহুর্তে যে ড্রেজিংটা করবো তা খুবই চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে। ড্রেজিং এর মধ্যে আমরা চেষ্টা করছি নদীর গতি পথটা পদ্মার ডান তীর থেকে মাঝ নদীতে নেয়ার। ইতোমধ্যে নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ এলাকায় আমাদের একটি ড্রেজার চলে এসেছে। সার্ভে শেষ করেই শুরু করবো ড্রেজিং এর কাজ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুরে পদ্মা নদীর ৩৯ কিলোমিটার তীর রয়েছে। এর মধ্যে নড়িয়ার মোক্তারেরচর, কেদারপুর, ঘড়িসার ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভা, জাজিরার কুন্ডেরচর ইউনিয়নে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় ভাঙনে এবার ৮ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। গত পাঁচ বছরে গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার এর অধিক পরিবার। এই এলাকার মধ্যে নড়িয়ার সুরেশ্বর এলাকায় ১ কিলোমিটার লম্বা বাঁধ রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে বাঁধটির প্রায় ৫০ মিটার নদীতে বিলীন হয়। এ বছর কয়েক হাজার কৃষি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ভাঙন কবলিত ক্ষতিগ্রস্তরা বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছে যতটুকু সম্ভব। এছাড়া বহুতল পাকা ভবনগুলোর বেশীর ভাগই ভেঙে নেয়ার মতো কোন প্রকার সময় সুযোগ পাননি। বাজারের পাকা দোকানগুলো নিজেদের উদ্যোগে ভেঙে কিছু ইট ও রড সড়িয়ে নিলেও বড় বড় মার্কেটগুলোর কিছুই নিতে পারেনি। সব সহই নদী গর্ভে চলে গেছে। তবে এখনও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়নি ভাঙন কবলিতদের। আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছেন নদী ভাঙণে ক্ষতিগ্রস্ত অসহয়া পরিবারগুলো। অনেক পরিবারই না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে বাস করছে।

এরই মধ্যে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ হাজার হাজার স্থাপনা!

মোক্তারের চর ইউনিয়ন: এর মধ্যে মোক্তারের চর ইউনিয়নে প্রাইমারী স্কুল ২টি, মসজিদ ১৩টি, একটি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ শত শত একর ফসলী কৃষি জমি ও কয়েক হাজার পরিবার ঘর বাড়ী হারিয়ে হয়েছেন নিঃশ্ব। এছাড়াও কয়েকশ পাকা ও আধা পাকা দালান নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। এর মধ্যে দুইটি ওয়ার্ডের ৭টি গ্রাম সম্পূর্ন নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। অন্য দিকে চেরাগ আলী বেপারী কান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভাঙন ঝুকিতে রয়েছে।

নড়িয়া পৌরসভায়: প্রাইমারী স্কুল ২টি। মসজিদ ০৪টি, লাইফ কেয়ার ক্লিনিক, গ্রাম ৪টি, বাশতলা বাজারসহ মুলফৎগঞ্জ বাজারের পৌরসভার একাংশ সম্পূর্ণ রুপে নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। টিন সেড ও পাকা বাড়ি আট শতাধিক ও কয়েক হাজার পরিবার ঘর বাড়ি হারিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে অনেক অসহায় পরিবারের আশ্রয় হয়েছে খোলা আকাশের নিচে।

কেদারপুর ইউনিয়নের ৪শ বছরের পুরানো ঐতিয্যবাহী মুলফৎগঞ্জ বাজারের একাংশ সম্পূর্ণভাবে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। এর মধ্যে মার্কেট তিনটি, দোকান ঘর সাড়ে তিনশ, ৪তলা ভবন বিশিষ্ট দেওয়ান ক্লিনিক, নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মসজিদ ৬টি, লঞ্চঘাট দুটি, মন্দির ১টি, ওয়াপদা বাজার, সাধুর বাজার ও চন্ডিপুর বাজারসহ কয়েক হাজার পরিবার তাদের বসত বাড়ী এবং ফসলী জমি নদীতে হারিয়েছে।

এছাড়া নড়িয়া থেকে মুলফৎগঞ্জ, চন্ডিপুর ও নড়িয়া পৌরসভার প্রায় ৫ কি:মি: পাকা রাস্তা, ৪টি ব্রীজ ও ২টি কালভার্ট নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। এছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আরো জানিয়েছে, নদী খননের জন্য যে ড্রেজার আনা হয়েছে তা যদি আরো আগে আনা হতো তাহলে নড়িয়া এত বেশী ক্ষয়-ক্ষতি হতো না। আমাদের যে ঢেউটিন দেয়া হচ্ছে তাদিয়ে আমরা কোথায় গিয়ে ঘর তোলবো? অন্যের জায়গায় কোন মতে আশ্রয় নিয়ে আছি। সরকার যদি আমাদের একটু খাস জায়গা দিতো তাহলে সেখানে গিয়ে স্থায়ীভাবে ঘর-তোলে থাকতে পারতাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ আমাদের যেন থাকার জন্য একটু খাস জায়গা দেন।

কেদারপুর ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার মুন্নি খান বলেন, পদ্মার ভাঙণে আমাদের যা কিছু ছিলো সব শেষ। এখন আমরা অন্যের বাড়ীতে ঘর ভাড়া করে আছি। মঙ্গলবার দুপুরে সর্বশেষ আমাদের বাড়িতে আমার দুই বোনের একটি তিন তলা বিল্ডিং ছিলো তাও নদী গিল্লা খাইলো সর্বনাশা পদ্মা। এই বিল্ডিংটা আমার বাবা আমার দুই বোন সালমা খান ও আসমা খানকে দিয়ে ছিলো। এর কিছুদিন আগে নড়িয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডে আমার আরেক বোন ঝর্ণা বেগম এর গাজী কালুর মেহমান খানা নামে একটি ৫তলা ভবন সাথে আরো একটি দুই তলা ভবনসহ বাড়ীর সামনের মসজিদটি একই সাথে চোখের পলকে নদী গর্ভে চলে গেছে। এছাড়া তাদের থাকার ৩তলা বাড়ীটিও অর্ধেকটা নদী গর্ভে চলে গেছে। মন্ত্রী, সচিব, ডিসি এসপিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের লোকজন আসে ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। আমরা নদী ভাঙণ কবলিত নড়িয়াবাসীরা ত্রাণ সহায়তা চাই না বেড়ী বাঁধ চাই। সরকারের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ যতদ্রুত সম্ভব বেড়ী বাঁধটি বাস্তবায়ন করে দিন। আমরা আর কিছুই চাইনা।

বাঁশতলার মিতুল মোল্লা বলেন, নদীতে তো আমাদের সবই নিয়া গেছে। আমাদের ভিটা বাড়ি জায়গা জমি কিছুই নাই, সবি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। ভিটা বাড়ির সাথে সাথে নদী কাইড়া নিছে আমার বাবা ও দাদা-দাদীর কবর। চাইলেও এখন আর তাদের কবরের পাশে দাড়িয়ে হাত তুলে দোয়া করতে পারি না। এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে? তার পরও যদি বেড়ী বাঁধটা দ্রুত বাস্তবায়ন হউক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কারন অন্যের জায়গা ভাড়া থাকলেও যাতে করে আত্মীয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকতে পারি।

নড়িয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কমিশনার আব্দুল লতিফ জানায়, আমি একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও সব হারিয়ে নিঃশ্ব। এখন আর কিছুই নাই আমার। অন্যের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে আছি। আমার অসহায় জনগণের সাথে সাথে আমিও এখন অসহায় হয়ে গেছি। নদীতে প্রথমে আমাদের ফসলি জমি যায়। পরে বাড়িগুলো যখন ভাঙতে শুরু করে তখন সকল মালামাল ও আসবাবপত্র সরিয়ে নিয়েছি। কিন্তু ইট দিয়ে তৈরি ৪তলা ভবনের কিছুই সরাতে না পারায় তা নদীগর্ভে চলে গেছে।

নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইসলাম বলেন, ভাঙন কবলিতদের আশ্রয়ের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভাঙন কবলিত ক্ষতিগ্রস্ত ৫ হাজার ৮১ পরিবারকে ত্রাণ ও ৩৭৫ পরিবারকে ৭৫০ বান্ডিল ঢেউটিনসহ বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বাররা আমাদেরকে যে তালিকা দেয় আমরা তারই প্রেক্ষিতে সাহায্য দিয়ে থাকি। এর বাইরে যদি কেউ বাদ পড়ে থাকে তা আমার জানা নাই। এরকম কেউ যদি থেকে থাকে আমার কাছে আসলে আমি তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিব। তবে উপজেলা ত্রাণ শাখার ১০৩৩নং স্মারক মূলে ১ হাজার ১শত ৬২ বান্ডিল ঢেউটিন, ৩ কোটি ৪ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা গৃহ নির্মাণ মঞ্জুরী, জিআর ক্যাশ ৩ কোটি আট লক্ষ ১০ হাজার টাকার একটি চাহিদা জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করেছি। চাহিদাকৃত বরাদ্দ পাওয়া মাত্র তা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের মাঝে বিতরণ করব।

পিডিএসও/এআই

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নড়িয়া,ভিটা হারা,নদী ভাঙন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close