প্রতীক ইজাজ
অর্থনীতির অনেক সূচক নিম্নমুখী
বাজেটে যত চাপ
অর্থনীতির নানামুখী চাপ নিয়েই আসন্ন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। একদিকে যেমন এ মুহূর্তে অর্থনীতির নানাসূচকের নিম্নগতি, তেমনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক ভাবনা ইতোমধ্যেই আলোচিত করে তুলেছে আসন্ন বাজেটকে। সীমিত সম্পদের বিপরীতে যেমন রয়েছে জনগণের বিশাল প্রত্যাশা, তেমনি রয়েছে আগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চাপও। নতুন করে আরো প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
বিশেষ করে ভোটের জন্য জনতুষ্টির বিষয় বিবেচনা করে এই বাজেটকেই ‘চাপাচাপির’ (জনগণের ওপর সিদ্ধান্ত চাপানো) শেষ বাজেট হিসেবে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে আসন্ন বাজেটকে। ‘চাপাচাপি’ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, চাপাচাপি মানেই জনগণকে বেশি কর দিতে হবে। বর্তমানে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ। আগামী বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা হবে ৩০ শতাংশ। ফলে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে জনগণকে বেশি করে কর দিতে হবে। এটিই হবে আগামী বাজেটের ওপর বড় চাপ। এমনকি নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে জনগণের ওপর চাপ পড়বে বলেও মনে করেন অর্থমন্ত্রী।
তার ওপর রয়েছে বাজেট নিয়ে মানুষের গগণচুম্বী প্রত্যাশা ও শঙ্কা। প্রতিবারের মতো এবারও বাজেটকে সুষম, গণমুখী, বাণিজ্যবান্ধব করতে রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের করদাতা, বিভিন্ন শিল্প ও বণিক সমিতি, পেশাজীবী সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও দেশের বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ ও সতর্কতা। এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুই মাসব্যাপী প্রাক-বাজেট আলোচনা শেষ হয়েছে ৪ মে। প্রতিবছরই বাজেটের আকারও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বাজেটে কোন কোন পণ্যের দাম বাড়বে বা কমবে এ নিয়েও আগ্রহ কাজ করছে জনসাধারণের মনে।
অথচ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু সূচক নিম্নমুখী। একদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অর্থ ব্যয় ও বাস্তবায়নে ধীর গতি রয়েছে। অপরদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এডিপি কাটছাঁট করা হয়েছে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও সংশোধন হচ্ছে। এমনকি চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন চাপের মুখে পড়েছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স, রফতানি প্রবাহে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে চাপের মুখে পড়েছে বৈদেশিক খাত। তার ওপর নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে লোকসানের মুখে থাকা সরকারি ব্যাংকগুলোকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ও কালোটাকা সাদা করার মতো উদ্যোগ নতুন করে সমালোচনায় ফেলেছে বাজেটকে।
ফলে আসন্ন বাজেটে বেশ কিছু বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। প্রাক-বাজেট আলোচনায় সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছেন তারা। দেশের সব খাত ও শ্রেণিকে বিবেচনায় নিয়ে বাজেট প্রণয়নের কথা বলেছেন। তারা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন ও বাজেট বাস্তবায়নের জন্য গবেষক, পরিকল্পনাবিদ, ব্যবস্থাপক এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে।
এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতির আয়তন ও প্রয়োজনের তুলনায় চার লাখ কোটি বা তার চেয়ে একটু বড় সাইজের বাজেট আসলে বড় নয়। চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করতে পারা। দক্ষতার সঙ্গে ব্যয়ের চ্যালেঞ্জ। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী ও খাতগুলোতে বাজেট বরাদ্দকে প্রবাহিত করার চ্যালেঞ্জ।
একইভাবে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বাজেট তখনই টেকসই হবে যখন কেউই তাতে বাদ যাবে না। বাজেটে প্রতিবন্ধীরা যেমন থাকবে, তেমনি দলিত শ্রেণি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, হাওরবাসী, দ্বীপবাসী, উপকূলবাসী এবং নারী শ্রমিকদের বিষয়টি আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে আছে, মধ্যম আয়ের দেশে যাচ্ছে। সেখানে যেতে হলে সবাইকে নিয়ে যেতে হবে। তাই এই গোষ্ঠীগুলোর দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত। সব মানুষকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অন্তর্ভুক্ত করার ভাবনা ও তা বাস্তবায়নের পথ থাকতে হবে বাজেটে।
এমন এক কঠিন বাস্তবতায় আগামী ১ জুন বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুুল মুহিত। এ বছর বাজেটের আকার হবে চার লাখ ২১৮ কোটি টাকা। এটি অর্থমন্ত্রী হিসেবে হবে তার একাদশতম বাজেট। এ ছাড়াও এ বাজেট হবে সরকারের বর্তমান মেয়াদের চতুর্থ ও দেশের ইতিহাসে ৪৬তম বাজেট অধিবেশন।
অর্থমন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে আসন্ন বাজেটে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, শেষ পর্যায়ে চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন পুরোপুরি হবে না। বরাবরের মতো এটি সংশোধন করা হবে। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মূল বাজেট অপেক্ষা ১০ শতাংশ কমিয়ে সংশোধিত বাজেট নির্ধারণ করা হতে পারে। বিষয়টি আসন্ন বাজেটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, প্রতিবছর বাজেট ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বছরের মাঝামাঝি তা সংশোধন করা হয়। কারণ প্রকৃত বাস্তবায়ন ঘোষিত বাজেটের তুলনায় আরো কম। সরকারের টাকা ব্যয় করার সক্ষমতাও কম। এ জন্য ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সূত্রগুলো আরো জানায়, ব্যাংকিং খাত নিয়ে বাজেটে বড় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে। এ ঘাটতি বাজেট থেকে মেটানো সম্ভব নয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশাল এই ব্যয় মেটাতে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা (অনুদানসহ)। এ হিসাবে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি এই সাত মাসে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে এক লাখ তিন হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় হয়েছে ৯৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় কম থাকলেও এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ।
এদিকে এডিপি বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে। অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি এই আট মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৪ শতাংশ। এই সময়ে ছয়টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার বাস্তবায়নের হার ২০ শতাংশের নিচে রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই রফতানি আয় কমেছে প্রায় নয় হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই আয় পাঁচ দশমিক শূন্য আট ভাগ কম। তবে প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় এটি গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তিন দশমিক ২২ শতাংশ বেশি।
এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও কমেছে। বিদেশে শ্রমিক যাচ্ছে বেশি আর রেমিট্যান্স আসছে কম। প্রকৃতপক্ষে রেমিট্যান্স বেশি আসছে ঠিকই তবে অবৈধ পথে। ২০১৬ সালে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ কম রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এর প্রবাহ কমতির দিকে রয়েছে।
ভ্যাট-বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সামর্থ্য অনুযায়ী, ভ্যাট হার ১০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৫ শতাংশ থেকে সংশোধন করে তা ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে। ১৫ শতাংশ এ হারে ভ্যাট আরোপ জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে ও উসকে দেবে মূল্যস্ফীতি। এমনকি আগামী নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে। সবদিক বিবেচনা করে ভ্যাটের হার কমিয়ে ১২ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। যদিও নতুন আইনে সর্বক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের নিয়ম করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে হ্রাসকৃত হারে (বিশেষ ছাড়) আদায়ের বিধান বাতিল করা হয়েছে।
জানা যায়, আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন ধরা হয়েছে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) মূল্যস্ফীতি হয়েছে পাঁচ দশমিক ২৮ শতাংশ। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে বড় সমস্যা হচ্ছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা। তাই আগামী বাজেটে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনাই হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটের আকার বড় হলেও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়ছে না। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি সম্প্রসারণশীল বা বড় বাজেট নেওয়ার অবস্থা বিদ্যমান। তবে বড় বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়াতে বড় বড় নীতি সংস্কার করতে হবে। তারা ভ্যাট প্রসঙ্গে বলেন, ভ্যাটের হার ক্রমান্বয়ে ১৫ থেকে ১২ শতাংশে নিয়ে আনা উচিত হবে। কেননা বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনীতিতে তুলনীয় দেশগুলোতে ভ্যাটের হার ১২ শতাংশ রয়েছে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, নয় মাস যাওয়ার পরও এডিপির ৫০ ভাগ বাস্তবায়ন হয় না। চলতি বছরে একটি প্রকল্পে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২১ শতাংশ। বাজেট যে বাস্তবায়ন হচ্ছে না সেদিকে কারো কোনো জবাবদিহি নেই। বাজেট বাস্তবায়নকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে একটি অংশ ব্যয় এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে বাজেট বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হতো বলে জানান তিনি।
পিডিএসও/হেলাল