পরিবেশবান্ধব বাঁশ ও বেতের ব্যবহার বাড়াতে হবে
প্রাচীনকাল থেকে মানুষের ব্যবহার্য বাঁশ-বেতের কদর ছিল। জনজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই বাঁশ ও বেতশিল্প। দূর অতীতে প্রতিটি বাড়ির গৃহস্থালি কাজে বাঁশ-বেতের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার করা হতো। ঘর সাজানো হতো বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিস দিয়ে। এ জন্য গ্রামে ছিল বাঁশ ও বেতের বাগান। সেখান থেকে বাঁশ-বেত কেটে গ্রামের কৃষক তৈরি করত নানা ধরনের জিনিস। এসব সামগ্রী ছিল গ্রামীণ জীবনের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ, যা গ্রামের প্রতিটি বাড়ির গৃহবধূ ও নারীর কাছে ছিল গৃহস্থালি অলঙ্কার।
সময়ের পরিবর্তনে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে পরিবেশবান্ধব বাঁশ ও বেতশিল্প। আধুনিক যুগে এসে এ শিল্পের জায়গা দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিকের পণ্য। এসব পণ্য যে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সেটা কারো অজানা নয়। তা সত্ত্বেও প্লাস্টিকের পণ্য সহজলোভ্য হওয়ায় এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। একদিকে অধিক মুনাফার জন্য ব্যবসায়ীরা প্লাস্টিক পণ্যের বাজার প্রসারিত করছেন, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম দামে সহজে হাতের নাগালে পাওয়ায় সর্বস্তরের মানুষ তা দেদার কিনছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এর বিরূপ প্রভাবে মানবদেহে ক্যানসার, অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি হয়। পরিবেশবিদদের মতে, প্লাস্টিক দূষণ ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) জন্য অশনিসংকেত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে মানুষসহ সমগ্র জীবজগৎ। তাই প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক না হলে রয়েছে মহাবিপদের শঙ্কা। প্লাস্টিক মাটি ও পানিতে ফেললে পচে না, গলেও না। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার শেষে মাটি কিংবা পানিতে ফেলে দেওয়ার পর তা থেকে যায় অনন্তকাল। এর ফলে মানুষসহ পুরো জীবজগৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রায় সবকিছুতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ায় দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ ও বেতশিল্প। গ্রামীণ গৃহস্থালি সামগ্রীর মধ্যে আছে কুলা, ডালা, ধামা, চালুনি, টোনা, ঠুসি, ঝাঁটা, পাল্লা, হোঁচা, চাঙারি আঙিনায় হাঁস-মুরগি ঢেকে দেওয়ার বিশেষ ধরনের ঝাপি ইত্যাদি। মাছ ধরার সামগ্রীর মধ্যে আছে পলো, দাড়কি, খলুই, টানা জাল ও বিভিন্ন ধরনের ঠুসি। আম পাড়ার এক ধরনের ঠুসি তৈরি হয়। শিশুদের খেলনাপাতি, দোলনা। র্যাক, বুকশেলফ ইত্যাদি বানানো হয়। অতীতে বাঁশের তৈরি নানা ধরনের সামগ্রী বাঙালির ঐতিহ্যের তালিকায় বড় আসন করে নিয়েছিল। এসব সামগ্রীর সঙ্গে যুক্ত হয় নানা ধরনের হস্তশিল্প। নকশি ওয়ালম্যাট, টেবিল ম্যাট বাঁশের কাঠিতে তৈরি দরজা ও জানালার পর্দা ইত্যাদি। ঘর সাজানোর এই পর্দা বনেদি বাড়ির আভিজাত্য বহন করত। তবে সেই এখন হারিয়ে গেছে। প্লাস্টিক পণ্যের প্রসারের ফলে হস্তশিল্প কারিগররা দুর্দিন পার করছেন। আধুনিক যুগে এসে ক্রেতা ও সরঞ্জামসংকট পড়েছেন এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তবুও ঐতিহ্য আর পারিবারিক অভাব-অনটনের মধ্যেও এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার কোনো কোনো কারিগর। অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য পেশার মতো সরকারি সহায়তা বা ভর্তুকি পেলে হয়তো টিকে থাকতে পারবে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে বাঁশ ও বেতের পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাঁশ-বেতের তৈরি শিল্পকর্ম তৈরি ও রপ্তানিমুখী করা যায় কি না- এ বিষয়েও কোনো উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
"