দিলারা মেসবাহ

  ০৮ মার্চ, ২০২৪

বই আলোচনা : নূর কামরুন নাহারের গল্প

শিল্পরূপের আপ্তবাক্যে জীবনের কোলাহল

শুরুতেই বলতে চাই, নূর কামরুন নাহার মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত- কখনো উচ্চবিত্তের অন্দরে চুপিসারে ঢুকে পড়েন। অতঃপর সচেতনবোধ ও পর্যবেক্ষণের আলোর শিখাটি প্রক্ষেপণ করেন। তাড়িয়ে তাড়িয়ে বহু যত্নে, দরদিয়া স্বভাবে। ব্যস্ততার ডুবসাঁতারে যেটুকু মহার্ঘ্য সময় তিনি পান, সেটুকু নিবিড়। বেহুলার বাসরঘর। ওই আলোক সম্পাতের সঙ্গে থাকে চিনে নেওয়ার অন্তরঙ্গ চিহ্নাদি। নূর কামরুনের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘গুচ্ছগল্প’ নিয়েই এ নাতিদীর্ঘ আলোকপাত।

গুচ্ছগল্পের প্রথম গল্প লিনু আর লিনার কথোপকথনে ডগমগ করে লতিয়ে ওঠে মধ্যবিত্তের স্বপ্নযাত্রা। ‘লিনু ও আমি’ গল্পে যাপিত জীবনের টানাপোড়েনে ভেসে যায় বহুরঙা স্বপ্নের মসলিন বুনন। জীবন তো এইরকমই। আশা-নিরাশার যুগলবন্দি। অধরা প্রাপ্তিযোগের নিত্য খেলা। সাদামাটা কথাকাহিনি, কিন্তু এরই আড়ালে যে চিত্র প্রস্ফুটিত সেটি অসাধারণ।

‘দখিনা হাওয়া’ গল্প জুড়ে আছে মাহিন চৌধুরী নামের এক শিল্পপতি। নূর কামরুন প্রায় প্রতিটি গল্প উত্তম পুরুষে লিখেছেন। মাহিন ধনাঢ্য এবং রূপবান পুরুষ। মহিলাবিষয়ক লেখার সূত্রে তরুণীটির সঙ্গে পরিচয়। এই গল্পে প্রণিধানযোগ্য যা সেটি হলো, একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর মনোবিশ্লেষণের বিচূর্ণ আলোর আভাস। মধ্যবিত্ত আটপৌরে সংসারী বিবাহিতা তরুণীকে চৌধুরী টেনে আনেন এক অন্য জগতের অভিজ্ঞতায়। যেখানে বিত্তের নান্দনিক দুকূলব্যাপী ঢেউ। সে ঢেউ-এ ভাসতে গিয়ে ভাসে না জীবন। মাহিন চৌধুরীর পরিমিতিবোধ অন্য মাত্রা সংযোজন করে গল্পে। আর অবিচল লড়াকু নারীর জবানে, ‘আমি জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা এক মহিলা, আমার বাতায়নে দখিনা বাতাস যতই আছড়ে পড়ুক, আমাকে দেখতে হবে- রোদের তেজ, পাতাহীন বৃক্ষের সৌন্দর্য।’ নিটোল বন্ধুত্বের দুর্লভ আমেজ, আত্মশক্তির ঝিলিকের নারী অন্যআলোয় সমৃদ্ধ করে গল্প।

‘ফাঁক’ গল্পটি নিশি আর অমলের দাম্পত্য জীবনের খানিক আভাস। আপাত সুখি ভাবাপন্ন জীবনেও সুপ্ত থাকে এক অভিনব হাহাকার। এ যেন মানবাত্মার মহামুক্তির নিরুচ্চার ক্রন্দন। ‘ঐ চাঁদ কি কোনো দিন জানতে পারে তার জোৎস্নাও কখনো কখনো আড়াল করে সামান্য পাতাবাহার।’ একজন মানুষ তার আট কুঠুরি নয়, দরজার সবটুকু ভুলভুলাইয়ার সুলুক সন্ধান জানতে পারে কী? একই ছাদের নিচে দুজন মানুষের দীর্ঘ বসবাস, কিন্তু পরস্পরের ভেতর মহলের খবর কে জানে? জীবনের ফাঁকটুকু শিরোধার্য! জীবন এমনই পলায়নপর, এমনই কঞ্জুস, এমনই হ্রস্ব। আবার এমনই প্রার্থিতও?

‘জীবন কখনো কাশফুল’ গল্পটি ইতিবাচক ভাবনার স্বাক্ষর। ধৈর্যশীল আর কৌশলী হওয়ার মধ্যে আছে গড়ে তোলার কারিশমা। মিনু, হাবিবের গলির স্যাঁতসেতে জীবনে আছে সংকীর্ণতা আছে মনকষ্ট। তথাপি আছে রোদের টেরাকোটা ঝিলিমিলি শরতের শুচিস্নিগ্ধ কাশফুলের অপার সৌন্দর্য। জীবনের গলি বেয়ে এমনি প্রবেশ করে জীবন-রস।

এবার আসা যাক ‘শাড়ি’ গল্পে। গল্পের নবীনা আর রাজ। রাজ এক অতি সংবেদনশীল সন্দেহপ্রবণ আত্মঅহংকারী চরিত্র। এ ধরনের মানুষগুলো জীবনভর বিবিধ টানাপোড়েন, সিদ্ধান্তহীনতায় অস্থির থাকে। সামান্য স্ফুলিঙ্গে ফুঁ দিয়ে দিয়ে অগ্নির দহন তৈরি করে। অতঃপর সেই অগ্নিতে ভস্ম হতে থাকে তার সব খেলাঘর। এই গল্পে উত্তম পুরুষে নূর কামরুন টানা নির্মেদ গদ্যে বিস্তারিত গল্প করেছেন পাঠকের সঙ্গে। এই বুঝি সব কালো মেঘ উড়ে গুমোট আকাশ ঝকঝকে হয়ে ওঠে- আবার মনে হয়, এই বুঝি এক অযাচিত উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে। নবীনা রাজের প্রার্থিতা- কিন্তু কেন নানা ভাঙচুর, সন্দেহের তির? অকারণে নবীনাকে মুহুর্মুহু বিদ্ধ করে। নিখুঁত বিন্যাসে এঁকেছেন নূর কামরুন। গল্পে লেখক উচ্চমার্গের মনোবিশ্লেষক। ‘ভেতরে যে নবীনাকে চাই আর যে সম্মুখে সে দুজনের মধ্যে প্রায়শ যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধ সশস্ত্র এবং তাতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।’ এই রক্তক্ষরণে আর্দ্র শাড়ি! কাচের দেয়াল তবে কি শেষতক অনতিক্রম্যই থেকে যায়? ‘রক্তে চিনি’ মায়াঘন দাম্পত্যের মাণ্যতা। পরস্পর প্রাত্যহিক অভ্যস্ত যাপিত জীবনের চেনা সুর বা ভালোবাসার আশ্লেষে এই মর্ত্যেও নেমে আসতে পারে অলীক স্বর্গ। তাড়িয়ে তাড়িয়ে নূর কামরুন সেই সুখকর জলছবিটি এঁকেছেন।

‘পাঁচ বোন’ গল্পে রয়েছে এক ম্যাসেজ। শ্রেণিবৈষম্য, উচ্চবিত্তের চাকচিক্য আর মধ্যবিত্তের রঙচটা যাপিত জীবনের দুস্তর ব্যবধানের এক অনিবার্য পরিণতি। এ এক কঠিন বাস্তবের উন্মোচন। এ গল্পও দীর্ঘ দীর্ঘতর টানা গদ্যভঙ্গিতে পল্লবিত। কিছুটা হ্রস্ব হলেও চলতো বোধ করি। নূর কামরুন নাহারের প্রায় প্রতিটি গল্পে আছে কিঞ্চিত চমক। আছে দার্শনিক ভাষ্যের ইঙ্গিত। অস্তিত্বের সংকট, মানবিক দ্বন্দ্ব, নির্মল ভালোবাসা, মনোবিশ্লেষণ সব মিলিয়ে যাপিত জীবনের আশ্লেষে গভীরতর মান্যতা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close