আলমগীর খোরশেদ

  ০১ মার্চ, ২০২৪

গ্রামীণ ঐতিহ্য

পালকি

আবহমান গ্রামবাংলার সবুজ শ্যামলিমায় মানুষের দিন কাটত আত্মীয়ের মতো, পাশাপাশি একসঙ্গে বিনি সুতোর বন্ধনে। ডাকাতপড়া, আগুনলাগা, চোর আসা, অসুখ-বিসুখ সবকিছুতেই সাহায্যে দৌড়ে এসেছে একে অন্যের প্রতি মায়ার টানে। যোগাযোগব্যবস্থা, যানবাহন বলতে তখন হেঁটেই চলেছে মানুষ মাইলকে মাইল। একটু অবস্থাসম্পন্ন যারা, তারা ঘোড়া কিংবা ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়িতে এক স্থান থেকে অন্য যেতেন। বিয়ের কাজে বর বা কনেকে বহন করত পালকি দিয়ে। পালকি চাকাবিহীন যানবাহন, যা মানুষের কাঁধে চড়ে ঝুলন্ত অবস্থায় চলার ব্যবস্থা থাকত। একটি বা দুটি লম্বা বাঁশ বা কাঠের দণ্ডে বড় চেয়ার বা খাট ঝুলিয়ে কাঠ বা বাঁশ কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে বানানো হতো পালকি। পালকির চারদিকে কাঠের আচ্ছাদন, ঢালু ছাদ, দুদিকে দুটি দরজা থাকত। বড় পালকিতে জানালাও থাকত। প্রাচীন ভারত ও চীনে রাজপরিবার দীর্ঘ ভ্রমণে পালকি ব্যবহার করত। উনিশশো শতকের শেষদিকে স্থানীয় বাবু বা জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিরা তাদের যাতায়াতে পালকি ব্যবহার করতেন। পালকি শব্দটি ইংরেজি পালকিটি এবং পর্তুগিজ পালকি থেকে গৃহীত। পালি ভাষায় পালকিকে বলা হয় ‘পালাঙ্কো’, হিন্দি ও বাংলা ভাষায় ‘পালকি’। পালকি কাঁধে নিয়ে ছুটে যেতে একটা তাল বা লয় ছিল, যা সবাই পারত না, তাই বেহারা হতে হলে ওস্তাদের কাছে আগে শিখে নিতে হতো। পালকি যারা বহন করত তাদের বলা হতো ‘বেহারা’। পালকিটি দুজন সামনে ও দুজন পেছনে এভাবে চারজন বেহারা কাঁধে করে বর বা কনেকে নিয়ে সুর ও ছান্দিক তাল লয়ে সামনে এগিয়ে যেতেন। তিন ধরনের পালকি ব্যবহৃত হতো- সাধারণ পালকি, আয়না পালকি ও ময়ূরপঙ্খী পালকি।

আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকত। ময়ূরপঙ্খী পালকির সামনের দিকে কাঠের তৈরি বাহারি ময়ুরের পেখমওয়ালা মুখ থাকত।

জমিদার বা ধনিক গোষ্ঠী তাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আরো দুজন পালকির সামনে হাতে বর্শা নিয়ে এগিয়ে যেত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে অবস্থানকালে তার জমিদারি কাছারি পরিদর্শন কাজে পালকি ব্যবহার করতেন। পালকিতে বর বা কনে, আর পেছনে হেঁটে বা গরুর গাড়িতে বরযাত্রীরা যেতেন। বেহারারা তালে তালে জোরে হাঁটতেন আর ছন্দ তোলে বলতেন, ‘হুন হুনা, হুন হুনা’। কনেকে পালকিতে চড়িয়ে নিয়ে যেতে বেহারারা গানের সুরে বলতেন- ‘স্বামীর সোহাগে সোহাগিনী হও কন্যা, সোহাগিনী হও, বাবা মাকে ছেড়ে কন্যা নতুন পরিচয়ে রাজরানি হও, কন্যা রাজরানি হও।’ রাস্তায় রশি বেঁধে বরকে আটকাতেন লোকজন। তখন তাদের বকশিশ, বাতাসা, জিলাপি দিয়ে খুশি করতে হতো। বর বা কনেকে দেখার জন্য ছোট ছেলেমেয়ে, প্রতিবেশী জড়ো হতেন। বাড়ি পৌঁছালে বর বা কনে পালকি থেকে নামলে ফুলের মালা আর লেবু চিনির শরবত, ধান-দূর্বা কুলায় রেখে বরণ করতেন মুরব্বিরা। স্বর্ণের চেইন গলায় দিয়ে বরকে বরণ করা রেওয়াজ ছিল।

পালকির প্রচলন কবে শুরু হয়েছিল, তার ইতিহাস জানা না গেলেও চতুর্দশ শতকে পর্যটক জন ম্যাগনোলি ও বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাদের ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে। পালকি ব্যবহারের কথা হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ রামায়ণেও বর্ণিত আছে।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে পালকি। এখন মাইক্রো, ক্ষেত্রবিশেষে হেলিকপ্টারে বউ নিয়ে যাচ্ছেন ধনীর দুলাল। পালকিতে বেহারাদের তালে তালে দৌড়ে যাওয়া, বাতাসা খাওয়ার আন্তরিকতা হারিয়ে গেছে যান্ত্রিক সভ্যতার কড়াল গ্রাসে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close