আরিফ মঈনুদ্দীন

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব- ৪)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

বিকেলের সমুদ্র- দেখতে এত ভালো লাগে, মনে হয় এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে যাত্রা করছে সবাই। সমুদ্রের ওপারে সেই কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী। সূর্য ডুবে যাবে আর ওপারে চলে যাবে সবাই। নতুন করে জীবন শুরু করবে। ভাবছে মেয়েটি...। তার দৃষ্টিতে বান্ধবীর গতিবিধির উদ্বিগ্নতা। বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে বান্ধবীকে দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির অন্যমনস্কতা বাবা টের পেল। বাবা মেয়েকে একটি চুমু খেল এই চুমুও আগের মতো। দেহের সঙ্গে যে চুম্বনের সরাসরি যোগাযোগ। মেয়েটির মনে পড়ল- তার এক বাঙালি বান্ধবী আছে। সে এক দিন বলেছিল- তাদের বাবারাও নিজের যুবতী মেয়েকে চুমু খায়, তবে সেটা ঠোঁটে অথবা গালে নয়, কপালে। সুন্দর করে সর্বোচ্চ শালীন মাত্রায়। যে চুম্বনে স্নেহের সরোবর সৃষ্টি হয়। ওই বান্ধবী বলত- সন্তানসন্তুতি যখন শিশু থাকে, তখন মুখের যেকোনো জায়গায় চুমু দেওয়া যায়। যখন তাদের ভেতর তারুণ্য এসে যায়, তখন বাবা চুম্বনের সব জায়গা ছেড়ে দেন ওদের প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য। বাবার চুমুর জন্য আজীবন নির্ধারিত থাকে পবিত্রতম জায়গা কপাল।

বাবার চুমুতে মেয়েটি স্বাভাবিক ছিল। সে ভাবল- এটাই তার বাবার জীবনের শেষ দংশন। এরকমই তো তার বান্ধবী ইঙ্গিত করেছিল। কিন্তু এখনো ওকে দেখা যাচ্ছে না কেন? মেয়েটি এবং তার বাবা হাঁটতে হাঁটতে মোটামুটি একটি ফাঁকা জায়গায় এসেছে। তারা সানসেট দেখতে তৈরি হলো। সমুদ্রের দিকে মুখ করে দুজন দাঁড়িয়ে। সূর্য ডুবতে শুরু করবে আরো পাঁচণ্ডসাত মিনিট পরে। অন্ধকার গ্রাস করবে পুরো জনপদ। হঠাৎ গুলির শব্দে সবাই আঁতকে উঠল। আঁতকে উঠল না মেয়েটি। পেছন দিক থেকে পরপর দুটি শব্দ হলো, রিভলবারের গুলি। পুরো সৈকতে হইচই শুরু হলো। মেয়েটির পাশে তার বাবার শরীরের অর্ধেক জলে এবং অর্ধেক বালিতে পড়ে গোঙাতে লাগল। মেয়েটির চোখ থেকে কোনো জল গড়িয়ে পড়ল না। সে অনুভব করল- তার শরীর হঠাৎ অসম্ভব রকম হালকা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, তার পরীর মতো পাখা গজিয়েছে। যেখানে খুশি সেখানে সে উড়ে যেতে পারবে।

এরই মধ্যে সব সৈকতচারী অকুস্থলে ভিড় জমিয়ে তুলেছে। কে-একজন গণহিতৈষী মেয়েটির মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে টেনে শুকনো জায়গায় নিয়ে এসেছে। মেয়েটি বলল, তিনি আমার বাবা। তার মৃত্যু কেন হলো আমি জানি। তবে তার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী নই। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির বান্ধবী দৌড়ে এসে রিভলবার উঁচিয়ে বলল, সমবেত ইউরোপীয় কমিউনিটি। তোমরা দেখো, এই লোককে গুলি করেছি আমি। ওর মৃত্যুর জন্য আমিও দায়ী নই। যদি বলি, ওই লোকটার মৃত্যুর জন্য তোমরা সবাই দায়ী, তবে বাড়িয়ে বলা হবে না।

তেরো-চৌদ্দ বছরের দুটো মেয়ের এসব কথায় সমস্ত লোকজন হকচকিয়ে গেল- বলে কী মেয়েগুলো! লোকটার মৃত্যুর সঙ্গে ওরা জড়িত অথচ বলছে তারা দায়ী নয়। বিষয়টা কী? দারুণ রহস্য মনে হচ্ছে। মেয়েগুলোর কথায় সবাই মৃত্যুপথযাত্রী লোকটার জন্য শোকের কথা ভুলে গিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার কৌতূহল এখন মেয়েগুলো। রিভলভার হাতে মেয়েটি এগিয়ে এল। বক্তব্যের ঢঙে সে বলতে শুরু করল, সমবেত ভাই ও বোনেরা, এই লোকটা আমার বান্ধবীর বাবা। তাকে আমি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে খুবই আগ্রহ নিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে পরামর্শ করে গুলি করেছি। কারণ তিনি ছিলেন একজন লম্পট বাবা। সুন্দরী এই মেয়েটার জীবনে বিষফোঁড়ার মতো ছিল যে বাবা। আপনারা জিজ্ঞেস করে দেখুন- আমার বান্ধবীর শরীর থেকে সত্যিই সত্যিই একটি বিষফোঁড়া ধীরে ধীরে ডুবন্ত সূর্যের মতো উধাও হচ্ছে কি না। যে বাবার বিশ্রি পৌরুষ তার মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দংশন করে, তাকে তোমরা কোন মুখে সুসভ্যের সংজ্ঞায় ফেলবে। যে বাবা পবিত্র সম্পর্কের মধ্যেও দৈহিক নির্যাসের সন্ধান করেন, তাকে পিশাচ বলা কি ঠিক নয়? তাই একটি পিশাচকে গুলি করে আমার মেয়েজীবন ধন্য করেছি।

এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ চলে এসেছে। পুলিশের লোকরাও মেয়েটির বক্তব্য শুনল কৌতূহলভরে। পুরো ঘটনা ঘটল মাত্র চার মিনিটে। চার মিনিটের মাথায় সূর্যটা ডুবে গেল। মেয়ে দুটোকে পুলিশ থানায় নিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় ওরা বলল, সমবেত সুসভ্য ইউরোপিয়ানরা, বাকি ঘটনাটা তোমরা আগামীকালের পত্রিকায় দেখো।

পরদিন সব জাতীয় পত্রিকায় এ চাঞ্চল্যকর খবর ফলাও করে প্রচার করা হলো। মেয়ে দুটোর স্বেচ্ছা প্রদত্ত জবানবন্দিসহ। ওরা পুরো ব্যাপারটা সবিস্তারে বর্ণনা করল। পুরো শহরে রি রি পড়ে গেল। পত্রিকার ভাষায় বোঝা গেল্ল- অনেক পরিবারেই এসব ঘটনা ঘটে। তবে যেটা প্রকাশ পেল সেটা সেম্পল মাত্র। সমাজহিতৈষী সাধারণ মানুষ উচ্চপর্যায়ের বুদ্ধিজীবী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিল। তারা সাধারণ মানুষের মূল্যবোধ এবং পরিবার জীবন পুনর্গঠনের অনুকূলে বিভিন্ন জুতসই বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া শুরু করল।

এর কিছুদিন পর এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের যে রায় হয়েছিল, তাও রাশেদা আক্তারের মনে আছে। মেয়েটির বান্ধবী নাকি বেকসুর খালাস পেয়েছিল এবং শুধু এক দিন জেল হয়েছিল মেয়েটির। তাও নাকি আইনের প্রতি স্বাভাবিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের খাতিরে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close