আসিফ উদ্দীন রেজভী

  ১৪ জানুয়ারি, ২০২২

আহমদ বশীরের ‘মুদ্রারাক্ষস’

বিষণ্ণতার ভেতরেও আলোর প্রচ্ছায়া

বইয়ের ‘রিভিউ’ নামের একটা জিনিস বাংলাদেশে মোটামুটি তৈরি হয়েছে। নিজে যেহেতু বইপত্র পড়ি, আমারও মাঝেমধ্যে রিভিউ লিখতে ইচ্ছে করে। হঠাৎ করে এমন এমন কিছু বই হাতে চলে আসে, যে বইগুলোর প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ার পর নড়েচড়ে বসি একদম। বইটা শেষ হওয়ার পরে মনে হয়, আমি মহাশূন্যে সাইকেল চালাচ্ছি। একদম ধাক্কা খাওয়ার মতো অবস্থা। কিছু কিছু বই আসলেই এমন যে, পড়তে পড়তে দেখবেন, গল্পটা আপনাকে একেবারে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে কমফোর্ট জোনের বাইরে। ঠিক এমনই একটা বড়সড় ধাক্কা আমি খেয়েছি, ‘মুদ্রারাক্ষস’ পড়ে।

আমি যেহেতু বইটির রিভিউ লিখতে বসেছি, তাহলে আমাকে বইটির ভেতরের কিছু কিছু জিনিসকে বাইরে এনে মানুষকে জানাতে হবে। জানি না, আসলে আদৌও কী কিছু লাভ হবে? আমি যদি লাভের হিসাব করি, তাহলে হিসাবটা এভাবে করা যায়, রিভিউ লিখে ব্যক্তিগত কোনো লাভ নেই। আরেকজনের বই নিয়ে নিজের সময় যায়, শক্তি যায়, চিন্তাখরচ করতে হয়। রিভিউ থেকে চাওয়ার মতো জিনিস খুবই অল্প। অন্তত ৫০ জন মানুষ- যাদের বইটির নাম কিংবা লেখকের নাম কখনোই শোনার কথা না, তারা যদি নামটা শোনেন, সেটাই প্রাপ্তি। অন্তত ১০ জন মানুষ যদি বইটা পড়তে চান বলে মনে মনে ঠিক করেন, সেটা প্রাপ্তি। অন্তত দুজন মানুষ যদি বইটা কিনে পড়েন, এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর নেই।

আমি আরো একটু নিজের কথা বলি, তারপর সোজা ঢুকে যাব ‘মুদ্রারাক্ষস’-এর অচেনা জগতের ভেতর। যেখানে কেউ কারো নয় আবার সবাই, সবার।

বইটা আমি হাতে পেয়েছিলাম আমাদের পাঠাগার থেকে। আমাদের পাঠাগার বলতে, আমাদের এলাকার পাঠাগার। আমাদের পাঠাগারে আছেন একজন চমৎকার মানুষ। সৈয়দ মনজুর মুরশেদ রানা ভাই। মানুষটার সঙ্গে আমার পরিচয় কিছুদিনের। কিন্তু এমনটা এখন আর মনে হয় না। ওনি হঠাৎ হঠাৎ আমাকে কিছু কিছু লেখকের নাম বলেন, পাঠাগারের শেলফ থেকে একটা বই বের করে দিয়ে বলেন, ‘এটা পড়ো তুমি। চমৎকার লেখেন। ভালো লাগবে তোমার।’

আমি সব বই ফেলে সেই বইটাই পড়া শুরু করি। এমন ভাবেই আমার হাতে আসে- আহমদ বশীর। এর আগে আমি কখনো ওনাকে জানতাম না। আমি রানা ভাইকে বললাম, ‘রানা ভাই, বইটা তো দারুণ।’

রানা ভাই সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, ‘তুমি আহমদ বশীরের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলবে?’

আমিতো থ! কী বলে রানা ভাই! এই না যে কথাটা আমি নতুন শুনতেছি। রানা ভাই সব সময়ই আমাকে কথাটা বলেন, আমার প্রিয় কোনো লেখকের নাম বললে, ওনি বলেন, ‘আচ্ছা সমস্যা নাই, আমি যোগাযোগ করাই দিবো।’

রানা ভাই যেদিন বললেন, ‘তুমি কি আহমদ বশীরের সঙ্গে ফোনে কথা বলবে?’ তখন আমি রাঙামাটির বনরূপা শহরের একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাচ্ছি। পাশে আমার মামা। আমি খাবার রেখে একটু পাশে গিয়ে রানা ভাইকে বললাম, ‘ভাই, আমি কি কথা বলবো? এত বড় মাপের একজন রাইটার, ওনি নিশ্চয়ই আমাকে পাত্তা দেবেন না।’

রানা ভাইয়ের ফোন কেটে যায়। একটু পর আবার ফোন দিয়ে বলে, ‘তুমি ওনার নম্বর নাও, এখনই ফোন দাও। ফোন দিয়ে আমাকে জানাও।’

আমি আহমদ বশীরকে ফোন দিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, জীবনের ফার্স্ট টাইম। ভয় লাগছিল অনেক। কিন্তু আহমদ বশীর অনেক বিনয়ী একজন মানুষ। আমি ওনাকে ‘মুদ্রারাক্ষস’ পড়ে ধাক্কা খাওয়ার ব্যাপারটা জানালাম। ওনি আমাকে ওনার আরো একটা বই সাজেস্ট করলেন। আহমদ বশীরের মতো লেখকদের ওপর সত্যিই রাগ হয়। এমন বই প্রচারবিহীন রেখে পাঠককে বঞ্চিত করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে জানি না। বইটার কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। কেউ এমন লেখকদের নিয়ে কথা বলে না। বা বললেও তা পৌঁছাতে পারে না সত্যিকারের রিডার্সদের কাছে। আর আমি লেখক এবং রানা ভাইয়ের এত এত প্রশ্রয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বইটার একটা রিভিউ লিখতে বসে গেলাম। যাতে কেউ কেউ হলেও বইটা সম্পর্কে জানতে পারে।

রিভিউ বলতে, বইটা পড়ে আমার কেমন লেগেছে, সেটাই জানাতে চাই। চিন্তা করে দেখলাম, এই বইয়ের রিভিউ লেখা আমার পক্ষে সম্ভব না। প্রথম দু-তিন পৃষ্ঠা পড়ে মনে হয়েছে বইটা কিছুটা ওভাররেটেড(?) কিছু কিছু জিনিস ধরতে সমস্যা হচ্ছিল খানিকটা।

এবার আসি ‘মুদ্রারাক্ষসের’ নির্মম সেই জগতে : ‘অঢ়ৎরষ রং ঃযব পৎঁবষবংঃ সড়হঃয’

বইটা প্রথমের দিকে একটা ধারা নিয়ে এগোতে থাকে। তথাকথিত সব উপন্যাসের মতো না এই বই। লেখক এখানে তিনটা পার্টে বইটাকে লিখেছেন। এটা তার পড়াশোনার জগতের পা-িত্য বলা যায়। নয়তো প্রথম এবং শেষ পার্ট ঠিকঠাক রেখে মাঝের পার্টে ওনি যে নির্মম খেলাটা খেলেছেন, তা একদম আমাদের চেনা। খুবই কাছের। দৃশ্যটা আমরা দেখি রোজ, কিন্তু ছুঁতে পারি না।

বইটি দাঁড়িয়েছে রাজনীতির নোংরা খেলা আর বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার নারীর নির্মম ইতিহাস দিয়ে। আমরা গল্পের শুরুতে দেখি জয়িতা নামের একজন মেয়েকে, যে কি না সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি দৌড়ে যায় স্নান ঘরে। গিয়ে দেখে সেখানে জল নেই। ডেকে তুলে মহিলা হোস্টেলের সেই নারী রক্ষিতাকে। গজগজ করে বলে, ‘পানি নাই কেন? একটু পরই কাজে বেরোতে হবে।’ কিন্তু কাজ হয় না। দেরি হয়ে যায় আধঘণ্টা।

আধঘণ্টা পরে জয়িতা পৌঁছে পান্না ফ্যাশন গার্মেন্টে। পৌঁছে সে দেখে নতুন এক দৃশ্য। নাকে ভেসে আসে জ্যান্ত মানুষের পোড়া গন্ধ। মানুষের চিৎকার, বাঁচার আহাজারি... এমন ঘোলাটে পরিবেশের সামনে দাঁড়িয়ে জয়িতা ভাবে, সে যদি আজ আধঘণ্টা দেরি না করত, তাহলে সে-ও হয়তো এখানে জ্বলতে থাকত। কিন্তু জয়িতার আনন্দ হয় না। জয়িতার দুঃখ হয়। বুক ভারী হয়ে আসে। তার এমন অসময়ে কেউ একজন যদি ফোন করে বলত, ‘জয়িতা ঠিকঠাক আছো?’ এমন তো না যে জয়িতার কেউ নেই। আছে তো একজন, যে কি-না চাইলেই নিতে পারত জয়িতার খবর।

জয়িতা শাফায়েতের কথা ভাবে। একজন ছন্নছাড়া যুবক, যে কি না অপেক্ষা করে আছে একটা গল্প লেখার জন্য। আপাতত তার সবচেয়ে জরুরি কাজটাই হলো, একটা গল্পের থিম তাকে খুঁজে বের করতে হবে। মাঝেমধ্যে সে জয়িতার কাছে আসে, গল্পের কথা বলে। জয়িতাকে দিয়ে থাকে প্রতিশ্রুতি। কিন্তু শাফায়েতের গল্প লেখা আর হয়ে উঠে না। উপন্যাসের কোনো একটা সময়ে এসে আমরা দেখতে পাব, শাফায়েত নামের সেই গল্পকার প্রেমিককে জীবনের একটা চেনা ফাঁদে পা দিয়ে হারিয়ে ফেলে জয়িতা।

এবার আসি দ্বিতীয় পার্টে। পুরো গল্পটার সবচেয়ে ক্লাইমেক্স দৃশ্যটা রয়েছে এখানেই। এই পার্টেই লেখক তার পা-িত্যকে নিখুঁতভাবে দেখিয়েছেন। টানটান উত্তেজনা দিয়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে গল্পের মোড়।

এই অংশে আমাদের সঙ্গে পরিচয় হয় একজন বেপরোয়া যুবকের সঙ্গে। যার নাম, জুলহাস। যে কি না দীর্ঘ একটি রাত অপেক্ষা করে শুধু সকালের জন্য। সকাল হলেই বদলে যাবে তার ভাগ্য। সংসারের সাধারণ ঝড়-ঝঞ্ঝা ফেলে যুবকের ভেতর জেগে উঠে রাজনৈতিক ঝড়। লেখক যুবককে নামিয়ে দেয় একটা খেলায়। কিন্তু যুবক জিততে পারে না সেই খেলায়। ঘটনা হতে থাকে ক্রমেই রহস্যময়। জীবনের পাকচক্রে পড়ে যুবক তলিয়ে যায় অতলে। সমাজ, সমাজের রাজনৈতিক নেতা, সামান্য একটা স্বপ্ন- সবকিছু খানখান হয়ে যায় যুবকের। সেই যুবককে লেখক নিয়ে আসেন আমাদের সেই প্রথম অংশে, যেখানে আছে আমাদের জয়িতা।

জয়িতার গার্মেন্ট পুড়ে গেলে সে এসে যোগ দেয় নতুন একটা জায়গায়। যেখানে সে আন্দোলন করবে শ্রমিকের অধিকারের জন্য। জয়িতা ঘুরতে থাকে একটার পর একটা গার্মেন্টে। তার সঙ্গে দেখা হয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে। সঙ্গে থাকে সেই ক্ষিপ্ত যুবক- জুলহাস। শাফায়াতের জায়গা দখল করে জুলহাস। জয়িতার নগ্ন স্তনে ঠোঁট রাখার অধিকার পেয়ে যায় সে। কিন্তু সে অধিকার বেশিদিন টিকে না। কিছু কিছু মানুষ জীবনে আসেই চলে যাওয়ার জন্য।

গল্পের শেষের দিকটা অনেকটা অন্যরকম। একের পর এক দেশের বড় বড় গার্মেন্টে আগুন লাগতে থাকে। কেউ জানে না কে ঘটাচ্ছে এ ঘটনা। সবার মনের ভেতর সন্দেহের তীর ঝুঁকে আছে একেকজনের দিকে। কিন্তু কেউ কারো নাম বলে না।

লেখক হিসেবে ওনি আসলে ওনার ক্ষমতা দেখিয়েছেন এই বইয়ে। গল্পের প্রতিটি মানুষ এতটা নিঃস্ব, এতটা একা যে, মাঝেমধ্যে সেই বিষণœœতার জগতে ঢুকে পড়েছি নিজেও। গল্পের প্রতিটি মানুষই একে অপরের কিন্তু কেউ কারো নয়। কেবল আমরা দেখতে পাই, অসহায়ত্ব আর রাজনীতির নোংরা খেলা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close