আহসান হাবিব

  ০৬ মার্চ, ২০২০

জলজীবন

জীবনের গভীর সত্য বেদনার সঙ্গে উঠে এসেছে

জলের জীবন কেমন? কিংবা আমাদের জীবন কি জলের মতো? তরল, বায়বীয় এবং কঠিন জলই একমাত্র বস্তু যার এমন তিন ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে যা আর কোনো বস্তুর মধ্যে নেই। জল গড়িয়ে পড়ে, জল ঝরে, জল উড়ে বেড়ায়, জল কঠিন হয়ে জমাট বাঁধে। মানুষের জীবন কি এমনি? কখনো তরল, কখনো কঠিন, কখনো বায়বীয়?

আসলে মানুষের জীবন মানেই সামাজিক জীবন। একা মানুষের কোনো জীবন নেই, যখন সে সম্পর্কিত হয়, জীবনের গঠন তৈরি হয়। এই সম্পর্ক শুধু যে মানুষের সঙ্গে মানুষের তাই নয়, এই সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রই মানুষের চেতনাকে আকার দেয়, সেই আকারে মানুষ নিজেকে খাপখাওয়ায়, নিজেকে ভাঙে, গড়ে। কখনো কখনো ফুঁসে দাঁড়ায়, নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলে।

একজন কথাসাহিত্যিক সেই সম্পর্কগুলো দেখেন, কাছে থেকে, দূরে থেকে। তার দেখা যেখান থেকেই হোক, দেখেন গভীর অভিনিবেশ সহকারে, দেখেন যতটুকু খালি চোখে দেখা যায় তার চেয়েও অধিক যতটুকু দেখা যায় না। সেই না দেখা অংশগুলো তিনি তার তুলে আনেন তার লেখায়, তার সাহিত্যে। আমরা সেই সাহিত্য পাঠ করি এবং একটি বাস্তবের মুখোমুখি হই। সেই বাস্তব আমাদের দেখা বাস্তবের চেয়েও সত্য। যখন কোনো লেখক এই নির্মাণ করতে সমর্থ হন এই বিকল্প বাস্তব, যা চোখে দেখা বাস্তবের চেয়েও সত্য, তখন আমরা তাকে শিল্পীর মর্যাদা দেই।

কথাগুলো বলতে হলো একটি গল্পগ্রন্থ পাঠ করে। গ্রন্থের নাম ‘জলজীবন’। ছোটগল্পের বই, লেখক শ্রাবণী প্রামানিক। ১১টি গল্পে সাজিয়েছেন তিনি তার গ্রন্থটিকে। তার প্রতিটি গল্পে আমি যে জীবনের মুখোমুখি হয়েছি, তা জলের জীবন, সেই জীবন প্রায়শই তরল এবং বায়বীয়। কঠিন হতে দেখিনি। যারা কঠিন করে তুলেছে তাদের জীবন, তারা অল্প কিছু, সমাজের মাথা, কিন্তু শ্রাবণী সেই মাথাদের নয়, তিনি এঁকেছেন তরল জীবনের অধিকারী যারা তাদের। ফলে প্রতিটি গল্প এমন এক সত্যের মুখে দাঁড় করিয়েছে যে, গভীর বেদনা রিনরিন করে বেজেছে। তিনি এই জলজীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে কারো পক্ষে হেলে পড়েননি, গভীর সত্যকে তুলে এনেছেন। একজন সাহিত্যিকের সবচাইতে সেরা অবস্থান হচ্ছে নিজেকে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে সত্যকে তুলে আনা। শ্রাবণী তাই করেছেন অসাধারণ নিপুণতার সঙ্গে।

‘চিহ্ন’ নামের একটি গল্প আছে। সেখানে দেখি স্বামী তার স্ত্রীকে বাঁজা মেয়ে বলে উঠতে-বসতে আঘাত দেয়, নারীটি মুখবুজে সহ্য করে। সন্তান উৎপাদন করতে না পারার অপরাধে তাকে এই শাস্তি পেতে হয়। দারিদ্র্যের সংসার, স্বামী মনে করে সন্তান এলেই তার দারিদ্র্য ঘুচবে। তার দারিদ্র্যের কারণ এই সন্তান না হওয়া। এক দিন আঞ্জু নামের সেই নারী আঘাত সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, অচেনা পথ ধরে যেতে যেতে সে ভারতীয় বর্ডারে ঢুকে পড়ে, ধরা পড়ে ভারতীয় সৈন্যদের হাতে। থানায় নেয় তাকে, গভীর রাতে তাকে একজন সীমান্তরক্ষী ধর্ষণ করে, আঞ্জু কিছু বলে না, সহ্য করে। পরদিন তার আদালতে বিচার হয়, বিচারে তার ছয় মাস জেল হয়। জেলে দিন যায়, তিন মাস পর সে জানতে পারে তার পেটে সন্তান এসেছে। সে খুশি হয়, কারণ সে প্রমাণ করতে পেরেছে, সে বাঁজা নয় ।

প্রতিটি গল্পে সমাজের একটি শ্রেণির জীবন এত নিপুণ দক্ষতায় উঠে এসেছে যে, পাঠ শেষে কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়। অথচ সেই জীবন সেই কাল আমরা পেরিয়ে এসেছি। আমাদের যাপিত জীবনের এই যে শিল্পরূপ, তা আমাকে এত মুগ্ধ করেছে কেন তাহলে? একটাই কারণ, ভাষার সারল্যে সেই জীবনের গভীর সত্যগুলো বেদনার সঙ্গে উঠে এসেছে। একজন সাহিত্যিকের কাজ এটাই।

শ্রাবণী প্রামানিক একজন শক্তিশালী কথাসাহিত্যিকÑ ‘জলজীবন’ পড়ার পর এই ঘোষণা আমি দিতে চাই প্রত্যয়ের সঙ্গে। বইটি প্রকাশ করেছে ভাষাচিত্র। দাম ১৭৫ টাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close