রহিমা আক্তার মৌ

  ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

রিজিয়া রহমান

নন্দিত কথাশিল্পী

রিজিয়া রহমান বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এক উজ্জ্বল নাম। অর্ধশতক ধরে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় রিজিয়া রহমান রেখে গেছেন অসামান্য অবদান, আমাদের উপহার দিয়েছেন অসাধারণ সাহিত্যকর্ম।

লেখালেখিতে আগমন খুবই অল্প বয়সে। সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন কবিতার মাধ্যমে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় কবিতা-ছড়া দিয়ে সাহিত্যের হাতেখড়ি। প্রথম কবিতা-ছড়া ছাপা হয়েছিল ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায়। ১৯৫০ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প ‘টারজান’। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় তার কবিতা ছাপা হওয়ার মধ্য দিয়ে আগমন ঘটে দৈনিক পত্রিকায়। লেখালেখি চালিয়ে গেলেও বিরতি আসে কিছুটা। এরপর শুরু করেন বড়দের জন্য লেখালেখি। ১৯৬০ সালে ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় পাঠক তার গল্প পান। এরপর ইত্তেফাকে প্রকাশ পায় ধারাবাহিক উপন্যাস। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও রিজিয়া রহমানের প্রথম উপন্যাস ‘ঘর ভাঙা ঘর’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘ললনা’ পত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসে তার বিচরণ বিশাল। অবশ্য এসবের পাশাপাশি প্রবন্ধও লিখেছেন।

রিজিয়া রহমান হলেন স্বাধীনতা উত্তরকালের বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা নারী ঔপন্যাসিক। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই গল্পগ্রন্থে ‘লাল টিলার আকাশ’ গল্পটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ম্যাগাজিনে অশ্লীলতার অভিযোগে ছাপাতে নারাজ ছিল। পরবর্তীতে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সম্পাদনা বোর্ডকে রাজি করিয়ে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে রিজিয়া রহমান সাহিত্য পত্রিকা ‘ত্রিভুজ’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব, জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের কার্য পরিচালকের দায়িত্ব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যক্ষ হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে থাকলেও শেষ পর্যন্ত লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

‘চার দশকের গল্প’ বইয়ের প্রথম গল্পটি ছিল ‘সোনার হরিণ চাই’। আনন্দ আলোর সাক্ষাৎকারে সে বই ও প্রথম গল্প নিয়ে রিজিয়া রহমান বলেন, ‘সোনার হরিণ চাই গল্পে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে পাত্রপাত্রীদের মধ্য দিয়ে। সেখানে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া অভিবাসীদের নিঃসঙ্গতা ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে লিখেছিলাম।’

‘অভিবাসী আমি’ রিজিয়া রহমানের প্রথম আত্মজীবনীমূলক বই। এতে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার শৈশবের বর্ণনা দিয়েছেন। দ্বিতীয় আত্মজীবনীমূলক বই ‘নদী নিরবধি’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। এতে তার শৈশবের পাশাপাশি লেখকজীবনের বর্ণনা এসেছে। রিজিয়া রহমান বলেন, ‘আত্মজীবনীমূলক বই লেখা দরকারি বলে মনে হয়েছে, তাই লিখেছি। আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান ভাগ, রাজনৈতিক টানাপড়েন এসব আমি দেখেছি। ওই সময়টা আমাদের সমাজ, সাহিত্য এবং রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে আমার কাছে মনে হয়। তাই আমি ওই সময় নিয়ে লিখেছি। বলা যায়, ওই সময়টাকে ধরে রাখার জন্যই স্মৃতিকথা লিখেছি।’

বাংলাদেশ নদীর দেশ, নদী ভাঙন আমাদের জীবনের একটা বড় লড়াই। প্রতি বছর শহরমুখী হয় বসতভিটে হারানো মানুষ। যাদের জায়গা হয় শহরের বস্তিতে। রিজিয়া রহমান অনেক দিন এক বস্তির পাশেই ছিলেন বাসা নিয়ে। নিজের চোখে দেখেছেন তাদের জীবনযাত্রা, দুঃখ-কষ্ট। সর্বহারা সেসব মানুষের শহরে এসে গড়ে তোলা বস্তিজীবন নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ঘর ভাঙা ঘর’ দিয়েই শুরু হয় উপন্যাসের অধ্যায়।

রিজিয়া রহমান তার স্বামীর কর্মস্থল বেলুচিস্তানে কয়েক বছর অবস্থান করেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিলুচিস্তানের বিদ্রোহ হয়। সে বিদ্রোহকে কালাতের যুদ্ধের পটভূমিতে রিজিয়া রচনা করেছেন ‘শিলায় শিলায় আগুন’ উপন্যাসটি। চেতনায় নাড়া দেওয়ার মতো তার এই বই। বেলুচিস্তানের স্বাধীনচেতা মানুষগুলো কীভাবে শোষণ, নির্যাতন, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে অধিকার থেকে। তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরেছেন ‘শিলায় শিলায় আগুন’ উপন্যাসে। বিদ্রোহ আর সংগ্রামের মাঝেও তাদের মধ্যে যে আত্মচেতনা জাগ্রত হয়েছে, দেশপ্রেম উপলব্ধি করেছে তারা, তারই ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরেছেন রিজিয়া রহমান। একটা আনন্দ বা বেদনার ঘটনা তুলে ধরা যায়, কিন্তু সেই ঘটনায় সাহসের সঙ্গে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে মনের মাধুরী মিশাতে পারতেন রিজিয়া। তিনি নিজেও বলেছেন, গল্পের চেয়ে উপন্যাসে ব্যাপকতর বর্ণনা তুলে ধরা যায় বলেই উপন্যাস লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। নিজস্ব শিল্প ব্যবহার করতেন উপন্যাসে, যা পাঠককে প্রথম থেকে শেষ অবধি ধরে রাখা যেত।

‘রক্তের অক্ষর’ রিজিয়া রহমানের ভিন্নতর উপন্যাস। নিষিদ্ধ পল্লীর দেহ প্রসারিণীদের মানবেতর দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলি তুলে ধরেছেন এখানে।

রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাস আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দলিল। বাংলাদেশের জাতি গঠন ও ভাষার বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের সৃষ্টি। আর্যদের সঙ্গে উত্তর ভারত সংঘাত করে পরাজিত হয়ে দ্রাবিড় জাতি ক্রমশ দক্ষিণ ভারতের পর্বতসংকুল অঞ্চলে সরে আসে। অনেকে মনে করেন, দ্রাবিড় বং গোত্রের নাম থেকেই ‘বঙ্গ’ ‘বঙ্গদেশ’ ও ‘বংআল’ নামের উৎপত্তি। ৪৭-এর দেশভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন আর ৭১-এর স্বাধীনতা। এক একদিনের বা কয়েকটা যুগের নয়, এ আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস। ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের অর্জনগুলোকে নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন ‘বং থেকে বাংলায়’। ইতিহাসে ঐতিহ্যের পাশাপাশি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা তুলে ধরেছেন। দৈনন্দিন জীবনে তারা কী ধরনের বাধা অতিক্রম করে, নির্যাতন সহ্য করে, অন্যের আনন্দে হাসতে পারে, অন্যের কষ্টে কাঁদতে পারে; তা ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালিকে স্বপ্ন দেখানো, স্বপ্নকে বাস্তবায়নে রূপদান করার ইতিহাসও উঠে এসেছে এখানে।

‘অলিখিত উপাখ্যান’ হলো নীল বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে খুলনা অঞ্চলের এক বিপ্লবী রহিমউল্লাহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বীরত্বগাথা নিয়ে। মীজানুর রহমানের কর্মস্থল ছিল বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে। রিজিয়া রহমান সেখানে অবস্থানের সময় সাঁওতালদের জীবনচিত্র পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের শিকারি থেকে কৃষক ও পরে শ্রমজীবী হয়ে ওঠা, বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে রচনা করেন ‘একাল চিরকাল’ উপন্যাস। ঢাকার অতীত-বর্তমান আর মহানাগরিক জীবনযাপনের আত্মজৈবনিক চিত্র তুলে ধরেছেন ‘প্রাচীন নগরীতে যাত্রা’ উপন্যাসে। ‘আবে রওয়াঁর কথা’ উপন্যাসে লিখেছেন আমাদের বিলুপ্ত মসলিন শিল্পের তাঁতিদের বঞ্চনা আর অতৃপ্তি নিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন ‘কাছেই সাগর’ ও ‘একটি ফুলের জন্য’। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে রচিত উপন্যাস ‘হারুন ফেরেনি’; যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজদের ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস তুলে ধরেছেন ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close