নূর কামরুন নাহার

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

একাত্তরের দিনগুলি

বেদনা ও স্বাধীনতার বর্ণমালা

একাত্তরের দিনগুলি পড়তে গিয়ে মনে পড়েছিল আনা ফ্যাঙ্কের ডাইরির কথা। দুটোর মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। ওটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইহুদিদের ওপরে জার্মান সৈন্যদের অত্যাচারের কথা। ওই ডাইরিতে কিশোরীর দৃষ্টি ও পরিপক্বতা দিয়ে লেখা দিনলিপিতে উঠে এসেছে ইহুদিদের ওপর জার্মান সৈন্যদের অত্যাচার ও যুদ্ধের বিভৎসতা। একাত্তরের দিনগুলি এক শহীদের মা ও এক মুক্তিযোদ্ধার ডাইরি। এ ডাইরি অত্যন্ত নির্মোহভাবে তুলে এনেছে আমাদের সবচেয়ে গৌরবজনক ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর রক্তক্ষয়ী অধ্যায়কে।

একাত্তর আমাদের চেতনা, সত্তা ও অস্তিত্ব। আমাদের জীবন, বোধ, বিশ্বাস, রাষ্ট্রক্ষমতা, সমাজজীবন এবং রাজনীতিতে একাত্তরের প্রভাব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারি। একাত্তর নিয়ে ভালো সাহিত্যকর্ম, ভালো সিনেমা, ভালো নাটক নির্মিত হয়েছে কি না? আমাদের সাহিত্য একাত্তরকে যথাযথভাবে আঁকতে পেরেছি কি না? এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক, সংশয় ও অতৃপ্তি থাকলেও একাত্তর নিয়ে গ্রন্থ কম রচিত হয়নি। একাত্তরকে নিয়ে ভালো সিনেমার সংখ্যা একবারে হাতে গোনা হলেও বহু নাটক নির্মিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটা সঙ্গত কারণেই থেকে গেছেÑ একাত্তরকে আমরা কতটা আঁকতে পেরেছি? এ প্রশ্নের পাশাপাশি আরো একটা প্রশ্ন অতি তির্যকভাবে চলে এসেছেÑ একাত্তরের ইতিহাসকে কতটা অবিকল, নির্মোহ আর নিরপেক্ষভাবে পেশ করতে পেরেছি। আগামী প্রজন্মের সামনে একাত্তরের যে ইতিহাস রয়েছে তার ওপর আমরা কতটুকু আস্থা রাখতে পারি। খুব দুঃখজনক হলেও সত্য এবং জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জা, গ্লানি রাখার কোনো জায়গাই নেই যে, আমাদের সবচেয়ে অহংকারের, গর্বের এবং গৌরবের জায়গাটিকে আমরা নানা বিকৃতি, মিথ্যা আর রহস্যের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন করেছি।

একাত্তরের দিনগুলিতে সেই মেঘ সরিয়ে একজন মা, একজন গৃহবধূর দিনলিপির মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন একাত্তরকে। কোনো রাজনৈতিক নেতা, কোনো ইতিহাসবেত্তা, কোনো কূটনৈতিক বিশ্লেষকের চোখে নয়, একাত্তর ধরা পড়েছে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে মুক্তিকামী মানুষের মর্মবেদনায় ও দিনযাপনে। কেমন ছিল একাত্তর? কেমন ছিল সেই সময়ের ঢাকা? ইতিহাসের সেই ভয়াবহতম দিন, সেই গণহত্যার দিন কালো রাত্রি ২৫ মার্চইবা কেমন ছিলÑ

‘দূরে দূরে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দিক থেকে গোলাগুলি মেশিনগানের শব্দ আসছে, ট্রেসার হাউস আকাশে রংবাজি করে চলেছেÑ দূর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। উত্তরে-দক্ষিণে-পূবে, পশ্চিমে সবদিকেই দূরে আগুনের স্তম্ভ ক্রমেই স্পষ্ট ও আকাশচুম্বী হয়ে ওঠেছে।’ (একাত্তরের দিনগুলি, ২৫ মার্চ)

এই বর্ণনা প্রতক্ষদর্শী সাধারণ গৃহবধূর, ঢাকার একজন সাধারণ নাগরিকের। কিন্তু এই বর্ণনার মধ্য দিয়ে আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠছে ২৫ মার্চের ঢাকা সেদিনের বিভৎসতা ও সামরিক শাসকদের অত্যাচার। একাত্তরের দিনগুলি এভাবেই ধারাবাহিকভাবে তারিখ ও ঘটনা অনুযায়ী তুলে এনেছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। সেই সময়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া ও জীবন, দিনযাপনের আতঙ্ক ভয় ও কষ্ট এবং সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ যেন ছবির মতো ওঠে এসেছে এই দিনলিপিতেÑ

‘গোলাগুলির শব্দে এখনো আকাশ ফাটছে। মাঝেমধ্যে কুকুরের চিৎকার কানে ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন মানুষেরও চিৎকার। খুব অস্পষ্ট। নাকি আমার ভুল? এত বিরামহীন গোলাগুলির পরও কোনো মানুষ কি বেঁচে আছে চিৎকার দেওয়ার জন্য? আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা কাক, চিল কি কোনো পাখির ডাক নেই।’ (২৬ মার্চ, শুক্রবার ১৯৭১)

মানুষ আর প্রাণির এই সহাবস্থান, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও বিভৎসতায় সমগ্র প্রকৃতির স্তব্দ হয়ে যাওয়া, ভয়াবহ সেই সময়ের অনুপূক্সক্ষ বাস্তব ও জীবন্ত বর্ণনা উঠে এসেছে একাত্তরের দিনগুলির পাতায় পাতায়। একাত্তর বহু বহুমাত্রিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। সেইসব ঘটনার সঙ্গে বাঙালির অস্তিত্ব, বাংলা ভাষার ঐতিহ্য, রাজনীতি, ক্ষমতা দখল, আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পৃক্ততা, বহির্বিশ্বের স্বার্থ সবকিছু খুব ঘনিষ্টভাবে জড়ানো। এসব কিছু বাঙালির যুদ্ধটাকে যেমন জটিল করেছে, যেমন বহুমাত্রিকতা দান করেছে সেই সঙ্গে বাঙালিকেও করে তুলেছে দুর্দান্ত। লড়তে হবে, স্বাধীনতা আনতে হবেÑ এই দুর্মর চেতনা মুক্তিযুদ্ধকে পরিণত করেছিল করেছে গণমানুষের অস্তিত্ব ও প্রাণের লড়াইয়ে। এটি শাসকের সঙ্গে শাসকের লড়াই ছিল না, ছিল শোষিতের সঙ্গে শোষকের, জনগণের সঙ্গে শাসকের। শাসকেরা গণমানুষের এই দাবি, অস্তিত্বের এই দাবিকে আখ্যায়িত করেছিল কিছু দুষ্কৃতিকারীর বিশৃঙ্খলা হিসেবে। সেটিও ধারণ করেছে এই দিনলিপিÑ

‘৩১ তারিখে দুটো পত্রিকায় খবর বেরিয়েছেÑ দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশ। পত্রিকাতে ইস্ট পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার পথে এ কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। পূর্ব দেশের লেখার মাঝেখানে একটা লাইন একেবারে বুকে এসে ঘা মারল : ‘শান্তিপ্রিয় বেসামরিক নাগরিকদের যেসব সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী হয়রানি করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তা সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত হয়েছে।’ (৩১ মার্চ, একাত্তরের দিনগুলি)

এসব সংবাদ, দমনপীড়ন, রক্তের গঙ্গা বইয়ে দেওয়া, জনপদকে শ্মশানে পরিণত করেও দমিয়ে রাখা যায়নি মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির চেতনাকে। যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় চারদিকে। প্রতিটি মানুষ যেন জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে। এ সময় তরুণ যুবক কিশোরদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে যুদ্ধের উন্মাদনায়। এই রকমই এক তরুণ মার কাছে অনুমতি চাচ্ছে যুদ্ধে যাওয়ার।

‘রুমী খুব আস্তে কিন্তু দৃঢ় গলায় বললো, ‘আম্মা, আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’ (৯ এপ্রিল, একাত্তরের দিনগুলি)

একাত্তরে এক চেতনার জন্ম হয়েছিলÑ যে মা তার কোলের ছেলেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিল। বহু মা নিজে তার ছেলের যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করেছিল, দেশের জন্য সন্তানকে নিজ হাতে যুদ্ধসাজ পরিয়ে দেওয়ার যে কি নির্মম যন্ত্রণা আবার যুদ্ধজয়ে ছেলের সাফল্যের যে গর্ব অনন্য অসাধারণ হয়ে ফুটে ওঠেছে একাত্তরের দিনলিপিতেÑ

‘আমি জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললাম। ‘না, চাই নে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।’ (২১ এপ্রিল, বুধবার ১৯৭১)

একাত্তরের দিনলিপির একটা বড় দিক হলো সাধারণ ও সরলভাবে এই দিনলিপি তুলে এনেছে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যুদ্ধক্ষেত্র, যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ তাদের পরিকল্পিত অ্যাকশনের চিত্র স্পষ্ট করেছে এই দিনলিপি। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ১১টি সেক্টরে। সেক্টর টু ছিল খালেদ মোশারফের অধীনে। এখানে মেলাঘরেই শুরু হয় রুমীর মুক্তিযোদ্ধা জীবনÑ

‘সোনামুড়ার একবারে বর্ডার ঘেষে শ্রীমন্তপুর বলে একটা বর্ডার আউট-পোস্ট আছে। সেইটার কাছে একটা স্কুলঘরে খালেদ মোশাররফ তার ক্যাম্প করেছে। পাশেই একটা গোয়ালঘর আখতার ভাইকে দেওয়া হলো রোগী দেখার ব্যবস্থা করার জন্য। আখতার ভাই দুটো লম্বা তক্তা জোগাড় করে ঘরের দুপাশে খুঁটির ওপর পাতল, একটা হলো রোগীর বেড, অন্যটায় ওষুধপাতি, গজ ব্যান্ডেজ সাজিয়ে রাখল। সেইটাই হলো সেক্টর টু’র সর্বপ্রথম এক বেডের ক্যাম্প হাসপাতাল।’ (৮ আগস্ট, রোববার ১৯৭১)

এই বর্ণনা সেক্টর টু-এর। কিন্তু এই বর্ণনা আমাদের সামনে স্পষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সেক্টরগুলোর চেহারাও। এভাবেই গড়ে ওঠেছে অন্যান্য সেক্টরও। যুদ্ধ বদলে দেয় মানুষের অভ্যাস, কখনো নৈতিকতা, মূল্যবোধও। যুদ্ধ পাাল্টে দেয় মানুষ। নিরীহ মানুষ হয়ে ওঠে ভয়ংকর, প্রতিশোধে দৃঢ়, খুব ভীরু ছেলে হয়ে ওঠে সাহসী অদম্য আবার খুব সাহসী মানুষ হঠাৎ হয়ে পড়ে শিশুর মতো আতংকিত। এই যে মুক্তিযুদ্ধ বদলে দেয় তারুণ্য, বদলে দেয় মানুষের লক্ষ্য উদ্দেশ্য আকাক্সক্ষাকেÑ তা মনে করিয়ে দেয় আলবার্তো মোরাভিয়ার টু উইমেন উপন্যাসের মা মেয়ের গল্পকে। যুদ্ধ কীভাবে পাল্টে দিয়েছিল ধার্মিক নীতিবান লাজুক মেয়েটিকে।

দিনলিপি আমাদের চোখের সামনে নিয়ে আসে বিভিন্ন সেক্টর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তরুণ ছেলেদের বিভিন্ন প্ল্যান ও আ্যকশন নিয়ে ঢাকায় আসাÑ

‘গেরিলাদের অনেক কটা দল এখন ঢাকায়। তারা প্রতিদিনই সর্বত্র কিছু না কিছু অ্যাকশন করেই চলছে। ওদের ওপর নিদের্শেই আছে; প্রতিনিয়ত ছোট-বড় নানা ধরনের অ্যাকশন করে সামরিক জান্তা এবং পাক আর্মিদের সদাসর্বদা ব্যতিব্যস্ত , বিব্রত এবং আতঙ্কিত রাখতে হবে। শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা এমনভাবে অ্যাকশন করবে, যাতে পাক আর্মিরা মনে করে শহরজুড়ে হাজার হাজার বিচ্ছু কিলবিল করছে।’ (২০ আগস্ট, শুক্রবার ১৯৭১)

জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি তুলে এনেছে মুক্তিযুদ্ধের আরো খুঁটিনাটি বিষয়। যা একটা যুদ্ধ, তার পরিকল্পনা, কতগুলো প্রফেশনাল-নন প্রফেশনাল লোক, সরকারি-বেসরকারি, প্রশিক্ষিত- অপ্রশিক্ষিত, তরুণ, বৃদ্ধÑ এভাবে সবাই নিজের জীবন বাজি রেখে কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে তা স্পষ্ট করে তোলে।

‘খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশের সবকটা ব্রীজ আর কালভার্টের তালিকা চেয়েছে। সেইসঙ্গে ব্রিজ আর কালভার্ট ওড়ানোর ব্যাপারে কতকগুলো তথ্য।’ ( ৩ জুলাই শনিবার, ১৯৭১)

‘তারপর বাকা আর শরীফের দীন-দুনিয়া নেই। ৩৫০০ ব্রীজ আর কালভার্ট। সেসবের তালিকা বানানো কি চাট্টিখানি কথা?’ (৭ জুলাই বুধবার, ১৯৭১)

এই চিত্রের পাশাপাশি আবার দেখা যায় ঢাকায় কত কৌশলে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে আসছে কেমন করে কৌশলে নিয়ে আসছে অস্ত্রÑ

‘ক্যাপ্টেন হায়দার অনেক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এই দলকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন গেরিলা অপারেশন করার জন্য। ওরা গোপীবাগের পেছন দিক দিয়ে ঢাকায় ঢুকেছে। ঢাকার বাইরে বাইগদা বলে একটা গ্রামে ওদের বেস্ক্যাম্প, সেখান থেকে অল্পে অল্পে অস্ত্রশস্ত্র ঢাকার ভেতর দিয়ে আসছে।’ (১৭ অক্টোবর, রোববার ১৯৭১)

‘ভোরবেলা গ্রাম থেকে লোকেরা ঝুড়িভর্তি শাকশবজি নিয়ে ঢাকায় আসে। তাদের সঙ্গে মিশে সবজিওয়ালা সেজে ঝুড়িতে শবজির তলায় ছোট অস্ত্র লুকিয়ে আনে। বড় অস্ত্রগুলো সাধারণত বস্তার ভেতরে অন্য জিনিসের সঙ্গে ভরে রাত্রিবেলা নিয়ে আসে।’ (১৭ অক্টোবর,

রোববার ১৯৭১)

এই যে মুক্তিযোদ্ধাদের এত আপারেশন, ঢাকায় ব্যাংক ডাকাতির মতো ঘটনা, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউসে বোমা বিস্ফোরণ, গেরিলাদের আক্রমণ, পাকসেনাদের নাকানি চুবানি খাওয়ানো তার পেছনে কাজ করেছে কোন শক্তি? সেই শক্তির উৎস হলো সাধারণ মানুষের সর্বাত্মক সহায়তা এবং প্রাণের ভেতর থেকে ওঠে আসা দোয়া ও শুভকামনাÑ

‘জেলেরা মাছ দেয়, চাষিরা খেতের তরিতরকারি, একটু ধনী চাষি আস্ত গুরু পাঠিয়ে দেয়। নদীর ঘাটে জেলেরা একটা বড় ডুলা বেঁধে গিয়েছেÑ সকালে নদী দিয়ে যাবার সময় নিজ নিজ নৌকো থেকে যারা যা সাধ্যমত মাছ ওই ডুলাতে দিয়ে যায়। (৭ নভেম্বর, রোববার ১৯৭১)

এভাবেই মুক্তিযোদ্ধারা শূন্য থেকে হাজার, হাজার থেকে লাখে পরিণত হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে এঁকেছে নতুন একটি দেশ, বাংলাদেশ। দিনলিপিতে উঠে এসেছে এক সন্তানহারা মায়ের হৃদয়ের করুণ আর্তি। যে মা একদিন দৃঢ়তা নিয়ে বলতে পেরেছিলÑ ‘যা তোকে দেশের জন্য কোরবানি করলাম’, সেই সন্তানের মঙ্গল কামনায় শুধু সন্তান বেঁচে আছে কিনা এ তথ্য জানার জন্য দিনের পর দিন ধরনা দেয় পীর সাহেবের আস্তানায়Ñ

‘তবু আমরা সবাই পাগলাপীরের আস্তানায় ধরনা গিয়ে বসে থাকি। ...আমরা পরস্পরের দুঃখের কাহিনি শুনি, কাঁদি, দোয়া-দরুদ পড়ি, আবার নিজেদের মধ্যে দুঃখের কথা নিয়ে আলোচনা করি, আবার কাঁদি। এত লোক আসে পাগলাপীরের কাছে। অবাক হই সারা বাংলাদেশের যত ছোবল-খাওয়া লোকÑ সব যেন আসে এখানে।’ (১৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার ১৯৭১)

ছেলে হারানোর দুঃসহ শোকের মধ্যে একাত্তরের দিনগুলির পাতা ভারী হয়ে উঠে আর একটি ব্যক্তিগত শোকে। শুধু রুমী নয়, চব্বিশ বছরের সুখদুঃখের সঙ্গী স্বামী শরীফও চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র তিন দিন আগে হার্টঅ্যাটাকে বিনা চিকিৎসায় মারা যানÑ

‘পিজি-এর কতব্যরত ডাক্তার দুজন শরীফের বেডের দুপাশে দাঁড়িয়ে হাতে করে কার্ডিয়াক ম্যাজাজ দিচ্ছেন। আমি এ.কে খানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেশিনটা? মেশিনটা লাগাচ্ছেন না কেন?’

শরীফের বুকে হাতের চাপ দিতে দিতে একজন ডাক্তার বললেন, ‘লাগাবো কি করে? হাসপাতালের মেইন সুইচ বন্ধ। ব্ল্যাক আউট যে।’

মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে এক নারী তার ছেলে আর স্বামীকে হারিয়ে একবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ল। এ চিত্র, ব্যক্তিগত বেদনা, এই নিঃস্বতা শুধু একাত্তরের দিনলিপির লেখিকার না। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের চিত্র যেন এই। একদিনে বিজয়ের আনন্দ আর একদিনে প্রিয়জনেদের হারানোর শোক এই দুই নিয়েই তখন পুরো বাঙালি জাতি

অশ্রু সজলÑ

‘দলে দলে লোক জয় বাংলা ধ্বনি তুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কারফিউ উপেক্ষা করে।’ (১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১)

‘রুমী! রুমী কি বেঁচে আছে? আমি কি করে খবর পাব? কার কাছে খবর পাব? শরীফ এমন সময়ে চলে গেল? দুজনে মিলে রুমীর জন্য কষ্ট পাচ্ছিলাম, রুমীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন একাই আমাকে সব করতে হবে, একাই সব কষ্ট বহন করতে হবে।’ (১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১)

একাত্তরের দিনগুলো মুক্তিযুদ্ধের পূক্সক্ষানুপূক্সক্ষ বর্ণনায়, ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি, শহীদ মাতার গৌরব, নির্মোহভাবে একাত্তরের দিনগুলো বর্ণনায় এবং ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে অনন্য ও অসাধারণ হয়ে ওঠেছে। তাই এটি শুধু সন্তান হারানো এক শহীদ মা, এক সাধারণ গৃহবধূর দিনলিপি থাকেনি। হয়ে ওঠেছে মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ইতিহাস ও দলিল আর আমাদের বেদনা ও স্বাধীনতার বর্ণমালা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close