বঙ্গ রাখাল

  ২০ এপ্রিল, ২০১৮

সাহিত্য : আমাদের প্রত্যাশা

সাহিত্য এক প্রকার শিল্প। এই সাহিত্য কিছু শব্দ বা ভাষাকে কেন্দ্র করে নাটক, কাব্য, উপন্যাস, গল্প ইত্যাদি রূপের মাধ্যমে শিল্প হয়ে ওঠে। শিল্পকে বোঝার জন্য বা গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য সাহিত্যের জ্ঞান প্রয়োজন। সাহিত্য এমন একটি বিষয়, যার মাধ্যমে সন্ধান পাওয়া যায় সমাজের সব উপাদানের। যা মানব মনকে প্রভাবিত করে তোলে। শিল্পের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিউ টলস্টয় তার ডযধঃ রং ধৎঃ ্ বংংধুং ড়হ ধৎঃ গ্রন্থে বলেছেন, ‘কোনো মানুষ নিজের জীবনে কোনো সময়ে যে অনুভূতি আস্বাদন করেছেন তা নিজের স্মৃতিতে জাগিয়ে তোলা এবং নিজের মধ্যে জাগিয়ে তোলার পর অন্যরাও যাতে সেই একই অনুভূতি আস্বাদন করতে পারেন সে উদ্দেশে অভিনয়, রেখা, রং কিংবা শব্দের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত কোনো রূপের সাহায্যে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, এই হলো শিল্পের কাজ। শিল্প হচ্ছে এক প্রকার মানবিক ক্রিয়া। কোনো মানুষ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যা উপলব্ধি বা অনুভব করেছেন, যখন কতগুলো বাহ্যিক সংকেতের সাহায্যে সচেতনভাবে তিনি তা অন্যদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং অন্যরাও সেই উপলব্ধি বা অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হন ও একই উপলব্ধি বা অনুভূতি লাভ করেন, তখন সেই প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই শিল্প নিহিত থাকে।’ একজন সাহিত্যিক সচেতনভাবেই তার লেখনির মাধ্যমে শিল্পে সমাজকে উপস্থাপন করেন। কিন্তু তার আদর্শিক জায়গাটাও সৎ থাকতে হবে। নতুবা, সৎ সাহিত্য সৃষ্টি হবে না। তবে আজকে আমরা কী দেখতে পাই? শিল্প-সাহিত্যকে সমাজের ঘোলা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কুক্ষিগত করে রাখতে চান। কবি আবুবকর সিদ্দিক বলেছেনÑ ‘কোনো গরিব দেশের রাজনীতি যদি সুবিধাবাদী চরিত্রের হয়, তাহলে তার সাহিত্যে বেদশা লাগে। সে অবৈধ ম-লে সাহিত্য নিখুঁত থাকতে পারে না। তাকেও রাজনীতি পকেটে পুরে নিয়ে ফেরি করে বেড়ায় তার নিজের কোম্পানির উৎপাদিত দাঁতের মাজনের মতো।’ আপসকারী সাহিত্যিকরাও তাদের প্রাণকর্তা মনে করে আপসকামী সাহিত্য রচনা করে বেড়ান। অথচ, এই মানুষগুলো মুখে মুখে মানবিকবোধের কথা প্রচার করেন। বলেন বিপ্লবের কথা, কিন্তু তলে তলে বিলি করেন তেলবাজী।

পেশাদারিত্বের জায়গাটা সাহিত্যে এখনো তৈরি হয়নি। এই সাহিত্যকর্মীদের এমন কোনো কাজ নেই সাহিত্য করা ছাড়া। অথচ, এই মানুষগুলো কী পান? যে মানুষগুলো সারাটা জীবন অতিবাহিত করেন সাহিত্যের পেছনে, তারা শেষ পর্যন্ত পেট পুরে খেতেও পান না। জীবনযাপন আরো অনেক পরের কথা। সাহিত্য এমন একটি জায়গা, যেখানে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কাজ করতে হয়। জোর-জবরদস্তি করে দিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায় না। এই কর্মে যারা আসেন তারা প্রত্যেকেই নিবেদিতপ্রাণ হয়েই নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। একসময় দেশের সমস্ত মেধাবী সন্তানই সাহিত্য রচনা করেছেন। তাদের সাহিত্যের মধ্যে এক ধরনের মানবিকবোধের প্রখরতা ছিল, যা আজ মøান। আজ লেখকদের মধ্যেই রয়েছে নৈতিকতার অভাব আর এই নৈতিকতা না থাকলে আমরা কিভাবে আপসহীন কঠিন এক দ-ের মতো শিরদাঁড়া টানটান করিয়ে রাখব। যেহেতু, আমাদের নৈতিকতার অভাব, সেহেতু সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। যে যেমন মানুষ কিংবা যার ভাবনা-চিন্তা যেমন, সে তো তেমন সাহিত্য রচনা করবে। তার নিজের ক্ষমতার চেয়ে বেশি কিছু সাহিত্য রচনা করা সম্ভব নয়। যে কারণে আজ লেখক, কবিদের বেহাল অবস্থা। আর সাহিত্যের বাঁক বদলের জন্য নতুন আন্দোলন কিংবা চিন্তা-চেতনায় নতুনত্বের গুরুত্ব অনেক বেশি। বর্তমান কবিতা-গল্পে নতুনত্ব নেই, সে কথা বলছি না। তবে, আগেকার সাহিত্যিকদের সাহিত্যে যেভাবে মানবিক জায়গাটা তীব্রতা নিয়ে উঠে এসেছে, তা আজ আর তীব্রতার দাবি রাখে না। যেটুকু আজ আছে তার রং অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। যে সাহিত্য মানুষের মনে কোনো দাগ সৃষ্টি করে না, আমরা তাকে সাহিত্য হিসেবে অভিহিত করতে পারি না। বর্তমান সাহিত্য যেন জনজীবন বিচ্ছিন্ন। আমরা মানুষের জীবনযাত্রা কিংবা তাদের থেকে যতই সরে আসছি, ততই নিজেদের হারিয়ে ফেলছি। পৃথিবীতে যত ক্ল্যাসিক সাহিত্যই দেখি না কেন, সেগুলোর মূলে রয়েছে এই মানবিক সমাজ কিংবা মানুষের যাপিত জীবনযাত্রার বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সেই সাহিত্যই মহান সাহিত্য হিসেবে টিকে গেছে। সাহিত্য তো মানুষের জন্যই সৃষ্টি হয়। যাদের জন্য সৃষ্টি হয় সেখানে তাদের নিত্যদিনের জীবনযাপন কিংবা তাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, ভালো-মন্দলাগা থাকতে হবে। তবেই না পাঠক তাদের সাহিত্যকে গ্রহণ করবে। অন্যথায় যত ভালোই সাহিত্য রচিত হোক না কেন, পাঠক সেটি গ্রহণ করবে না।

সাহিত্যের জায়গা একটা পরিচ্ছন্ন জায়গা, কিন্তু আজ আমরা সেই জায়গাকে দিনকে দিন নোংরা করে ফেলছি। যেমন কবি বা লেখক হতে হলে মদ বা নারী নিয়ে মেতে থাকতে হবে। মদ আর নারীকে স্পর্শ না করলে কোনো কোনো লেখক কিংবা কবির লেখাই আসে না। আবার কিছু সাহিত্যিক আছেন, যারা নিয়মিত সিদ্ধি সেবন না করলে তাদের লেখার মাথা খোলে না। একজন যতবড় প্রতিভাবান ছেলেই অনেক স্বপ্ন নিয়ে সাহিত্য করতে আসুক না কেনÑ এসে যখন সে নিজেকে মানাতে পারে না, তখন লেখালেখি থেকে বিদায় নেয়। সে এসেই এই বিষয়কে মানতে পারে না কিংবা সমাজ ব্যবস্থাকে আমরা এমনভাবে সৃজন করতে সম্ভব হইনি যে, কবি-লেখকদের রাজকীয় কবিদের মতো সম্মানের চোখে দেখা হবে। সমাজে যখন একটা ছেলে কবিতা লেখে কিংবা সাহিত্য রচনা করতে আসে, তখন মানুষ তাকে উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে হিসেবেই ধরে নেয়। বলাবলি করে, তার দ্বারা কোনো কাজ-কর্মই হবে না। এ ছেলে এবার নষ্ট হয়ে গেল। তাকে আর কখনো ভালো পথে আনা যাবে না। আমরা আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। কেমন করে পারব, আমরা তো কবি-সাহিত্যিকের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারি না। সমাজের যারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন, যারা সমাজের বিবেক তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তাহলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কী করে পরিবর্তন হবে?

সাহিত্য সবসময় প্রতিবাদী ভাষা হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে। কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিবাদের ভাষা তাদের সাহিত্য। আজ কোনো প্রতিবাদী সাহিত্য নেই। যা আছে তা মিড়মিড়ে আপসকামী আর তেলবাজি সাহিত্য। বর্তমানে এই তেলবাজি করেও কেউ কেউ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন। সাহিত্যে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। বাউল-কবি লালন সাঁই বলেছেনÑ ‘এমন সমাজ কবে সৃজন হবে, যে সমাজে মানুষে মানুষে ভিন্নতা নাহি রবে।’ আমরা কি আজও সেই সমাজ সৃষ্টি করতে পেরেছি? সাহিত্য হবে গণমানুষের সাহিত্য। আমরা দিনদিন গণমানুষের সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। তাহলে আমাদের সাহিত্য কী করে মহান সাহিত্য হয়ে উঠবে।

সাহিত্য পাঠের মাধ্যমেই মানুষ নৈতিক মানুষ হয়ে ওঠে। তার মধ্যে গড়ে উঠে মনুষ্যত্ববোধ। আমরা সাহিত্য থেকে যতই সরে দাঁড়াচ্ছি, ততই নৈতিকতাহীন হয়ে যাচ্ছি, আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের লোভ পাচ্ছে। আমরা যতই অর্থ বা পুঁজিবাদের দিকে ছুটছি ততই মানবিকহীন জীবনযাপন করছি। সর্বোপরি মনুষ্যত্বহীন হয়ে উঠছি। যে কারণে, আমাদের ভেতরে প্রশান্তি নেই। সাহিত্য আমাদের এক ধরনের প্রশান্তি দেয়, যা অন্যকিছুতে পাওয়া যায় না। সে কারণেই সাহিত্য হয়ে উঠুক গণমানুষের সাহিত্য। তবেই না পেতে পারি মানবিক সমাজ। পরিবর্তন হবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি।

সৎ সাহিত্য সংগ্রামী সাহিত্য। এ সাহিত্য কোনো চাটুকারিতা পছন্দ করে না। কারণ, সৎ সাহিত্য সত্য কথা নিয়েই বাঁচে। লেখকরা তো আলাদা এক জগতের বাসিন্দা, কিন্তু সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়। তারা স্বাধীনভাবে তাদের সত্ত্বাকে জাগিয়ে রাখে। লেখকরা লিখতে গিয়ে একঘরে হয়েছে কিংবা মার খেয়েছে কালে কালে। এতকিছুর পরেও একজন লেখক বা কবি কখনো অন্যায়ের কাছে নতজানু হতে পারে না। বর্তমানে প্রেক্ষাপট আবার ভিন্ন। লেখকদের আজ সমাজে লেখক বলে পরিচয় দিতে বাধে। কারণ, সাহিত্যকর্মী কিংবা সাহিত্যের শ্রমিক বলার পরিচয় এখনো এই সমাজ ব্যবস্থায় তৈরি হয়নি। সাহিত্য করে পেটে ভাত জোটে না। লেখকদের পা বাড়াতে হয় রোজগারের দিকে অন্যপেশায়Ñ মাস্টার, কেরানি বা সাংবাদিকতায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist