-জিয়া হক
প্রতিবাদের প্রীতিলতা
শিরোনামটা প্রায় ধার করা। কবি ও কথাশিল্পী রুবাইদা গুলশানের অণুগল্পের বই সেফটিপিন। বইটির প্রথম গল্প ও সেফটিপিন গল্পের নায়িকা মৌনতা। মৌনতা নিজেকে ভাবেন প্রীতিলতা। এখান থেকেই শিরোনাম। বইটির নামকরণ বেশ মানানসই। নামকরণই ইঙ্গিত দেয় অব্যক্ত মুগ্ধতাবোধের। অপার রহস্যের। সেফটি পিন না সেফটিপিন?
লেখকের গল্পটা দেখা যাক- ‘প্রতি সপ্তাহে ডজনখানেক সেফটিপিন লাগে, স্কার্ফভর্তি সেফটিপিন লাগাতে লাগাতে হাতে ফুটে যায় মৌনতার। ইশ!
পাবলিক বাসে কলেজ থেকে বাসায় ফিরছে মৌনতা। মৌনতা জানালার কাচ সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবে- তার নাম হওয়া উচিত ছিল প্রীতিলতা। হাতের মুঠোর মাঝে রাখা সেফটিপিনটা জানালা দিয়ে ফেলে দিল। এটা আর রাখার প্রয়োজন নেই।
মৌনতা মনে মনে হাসে আর ভাবে-এই সেফটিপিন দিয়ে একটু আগে সে কিভাবে অপারেশন করল। উপায় ছিল না। বারবার বলা সত্ত্বেও লোকটা যে তার নিজের কনুই সামলে রাখতে পারছিল না। সেফটিপিন ফুটিয়ে দিয়ে মৌনতা বুঝিয়ে দিল- পাপ পাপই, হোক ছোট কিংবা বড়!’
সমাজে নারীকে প্রতিনিয়ত বাজে অভিজ্ঞতার ওপর পা ফেলে চলতে হয়। কখনো কখনো আত্মরক্ষায় নিতে হয় কৌশলী আশ্রয়। ভরা পূর্ণিমাকে লুকিয়ে রাখতে হয় ঘোর অমাবস্যায়। মমতাময়ী নদীর জল উপচানো ঢেকে রাখতে হয় রহস্যময় আবরণে। বুক পকেটের হাসনাহেনার মাদকতা শুকিয়ে নিতে হয় নিষ্ঠুর রোদের ভালোবাসায়।
‘আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই’ তবুও সমাজের বাস্তবিক ইমেজে জোর দিয়েছেন লেখক রুবাইদা গুলশান। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় আলো ফেলেছেন নিবিড়ে। দক্ষতায়। যা পাঠককে নতুন স্বাদ নিতে উৎসাহিত করে। সস্তা জনপ্রিয়তার স্থুল মোহে বুঁদ না হয়ে থাকা লেখক। তার জ্বলজ্বলে প্রমাণও মিলে সেফটিপিনের শেষ লাইনে- ‘পাপ পাপই, হোক ছোট কিংবা বড়!’ লেখকের কিছু গল্পে অন্যদের থেকে ভিন্ন রকম গন্ধের আভাস- বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না।
মিথ্যার পঙ্কিলতা থেকে মানুষকে ডাকেন সত্যের পথে। মানবিকতার পথে। মাত্র কয়েক লাইনের এই অণুগল্পটি পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন, হৃদয়ের সমস্ত নিবিড় নির্যাস পারঙ্গমতার সঙ্গে কলমে ঢেলে দিয়েছেন লেখক। তার কিছু গল্প পাঠককে নেশাগ্রস্ত করে। স্বপ্নবিলাসী করে। সাহসিকতার বয়ান শোনায়। শোনায় অধরা ভালোবাসার ছোঁয়া। কিছু গল্পে তিনি ভালোবাসাকে গতানুগতিক আশ্রয় দেননি। বলা যায় ভদ্রতার সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘চিরকুটের ফুল’ পাঠ করলে তার রহস্য বুঝতে পারবেন পাঠক। তিনি গল্পের সঙ্গে, গল্পের মায়াজালে মিশে যান কিন্তু একটা অভেদ্য দেয়াল রেখে; যেখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।
বাঁশ, শুভ্রাণু, ছোঁয়া, তারার ফুল, দূরত্বের শেষ প্রহরে গল্পগুলো ভালো লাগবে। পাঠক হেসে উঠবে। চোখ মুছবে। একটা সময় হয়তো বলে উঠবে- ‘এ তো আমারই গল্প। আমারই জীবন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক কৃতী শিক্ষার্থী রুবাইদা গুলশান। ধর্মান্ধতা, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতাসহ যাবতীয় অন্ধকারের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই করতে জানেন তিনি এবং বিজয়ীও হন। তিনি বোঝেন সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও বহমান নষ্ট সময়ের রাজনীতি। বর্তমান ঘুণেধরা সমাজের দিকে নজর দিলেই তার উপলব্ধির সত্যতাই দৃশ্যমান হবে। গল্পের আড়ালে জ্বলজ্বল করে অলিখিত দর্শন; যা চেতনে অবচেতনে আমাদের প্রভাবিত করে। উৎসাহিত করে।
রুবাইদা গুলশানের লেখার ভাষা, পটভূমি, ব্যাখ্যা এবং প্রকাশে কিছুটা স্বকীয়তা লক্ষণীয়। তিনি ব্যবহার করেছেন সহজ-সরল ও যতটা সম্ভব ছোট বাক্য। এজন্য তাকে বলা যায় ‘সার্থক’ চিত্রী।
জীবন-জীবিকার তাগিদে একজন লেখককে ‘অর্ধেক জীবন’ বিলিয়ে দিতে হয়। এতকিছুর পরেও তাকে নতুন করে ভাবতে শিখতে হবে। নতুন নতুন চিন্তার আলো টানতে হবে। বিশ্বসাহিত্যের পাতায় চোখ ফেলতে হবে পরম মমতায়। প্রজাপতির মুগ্ধতায়। জানতে হবে- কেন আমার গল্প অন্যদের থেকে পিছিয়ে কিংবা এগিয়ে? সেফটিপিনের সমাপ্তি শুনবেন?
বিকেলের চিরল রোদ্দুরে; সূর্য এখন পশ্চিমে।/সাথে চলছে পাহাড়িকন্যা; লজ্জাবতী সে যে।/কনে দেখা আলো মেখে চলে যায় দূর দিগন্তে/দেখে আসি শালের বনে;/কেমন করে উঠেছে চাঁদ সে বেঁকে।/প্রশান্ত নিঃশ্বাসে বনানীর তুমুল অভিসারে নির্ঝর সংগীতে,/আহা! কতকাল ধরে আহা!/কতকাল
তোমারি অপেক্ষায়!
সেফটিপিন
রুবাইদা গুলশান
প্রকাশনী : মূর্ধন্য
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য : ১৮০
"