আকিব হোসেন খান, কিশোরগঞ্জ

  ৩১ মে, ২০২৩

কিশোরগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস

লাগামহীন হিসাবরক্ষক

কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস নিয়ন্ত্রণ করেন আশরাফ আলী। পদবী সহকারী হিসাবরক্ষক হলেও ঊর্ধŸতন কিংবা অধনস্থদের পান থেকে চুন খসলেই আশরাফ আলীর দারস্থ হতে হয়। পাসপোর্ট সেবাপ্রত্যাশী কিংবা অফিসে আসা যে কেউই সহকারী হিসাবরক্ষক আশরাফ আলীর ছায়া ছাড়া ঢুকতে পারেন না। তিনি যাকে ইশারা দেন তাকেই ঢুকতে দেওয়া হয়। আর তা না-হয় গেটের ভেতরে প্রবেশ করা দুরূহ ব্যাপার।

পাসপোর্ট সেবাপ্রত্যাশীদের ফাইলে স্বাক্ষর করা আশরাফের কাজ না হলেও দিনের পর দিন তিনি কিছু সিন্ডিকেট ও দালাল চক্রের যোগসাজশে ফাইলে স্বাক্ষর করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী এমনকি আনসার সদস্যদের নামে ফাইল জমা হয় এ অফিসে। আনসার সদস্য ও অন্যান্য কর্মচারীর প্রত্যকেরই রয়েছে নিজস্ব সাংকেতিক চিহ্ন। পাসপোর্ট সেবাপ্রত্যাশীদের আবেদন জমা হওয়া প্রত্যেকটি ফাইলের বেশিরভাগ আবেদন ফরমের মধ্যেই থাকে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আগে থেকে ঠিক করা সিলমোহর (সাংকেতিক চিহ্ন)। আবেদন জমা হওয়ার পর সেইসব সাংকেতিক চিহ্ন চোখে পড়লেই কিছু না দেখেই এমনকি কোনো কোনো আবেদন যাচাইবাছাই না করেই পাস করে দেন আরেক কর্মকর্তা।

সহকারী হিসাবরক্ষক আশরাফ আলীর ছত্রছায়ায় সুইপার সেলিম মিয়া, আনসার সদস্য সোহেল, রবিউল, অফিস সহকারী কামকম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক এম এ হালিম, আনসার সদস্য মালেক ও অফিস সহকারী সাগরের রয়েছে আলাদা আলাদা সাংকেতিক চিহ্ন। যে চিহ্ন ব্যবহার করে ফাইল প্রতি ১১০০ করে টাকা দেন দালালরা। সপ্তাহ কিংবা প্রতি রাতে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে চলে কর্মকর্তা ও দালাল সিন্ডিকেটের গোপন বৈঠক। এসব বৈঠকে কোন কর্মকর্তা কোন সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করেন, সপ্তাহ কিংবা দৈনিক কার্যদিবসে কতগুলো ফাইল জমা করেন, তার হিসেব দেওয়া ও টাকা পরিশোধ করেন দালালরা।

কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে হয়রানির দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে সম্প্রতি নিগৃহীত হয়েছেন কিশোরগঞ্জের এক গণমাধ্যমকর্মী। সেবাগ্রহীতাদের বক্তব্য তুলে ধরে ওই সাংবাদিক বলেন, ‘দালালদের মাধ্যমে আবেদন করলে যথাসময়ে দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায়। তবে নিজে আবেদন করলে পাসপোর্ট অফিসে নানা ভুল ধরা হয়। স্থানীয়ভাবে পরিচিত লোকজন কিংবা দালালদের ঘুষ ছাড়াই আবেদন করেছে জানিয়ে গুটিকয়েক উপপরিচালকের কক্ষে গেলে তাদের পাসপোর্টও দ্রুত দিয়ে দেওয়া হয়। এতে গুটিকয়েক সেবাগ্রহীতা সন্তুষ্ট হলেও বেশিরভাগই দালালদের ঘুষ দিয়ে অসন্তুষ্ট।’

সেবাপ্রত্যাশী হাসানুল হক নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘যারা স্থানীয় পরিচিত ব্যক্তি অথবা পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে আসেন তারা উপপরিচালকের হাতে সরাসরি কাগজপত্র জমা দেন। তাদের সরকার নির্ধারিত টাকা খরচেই পাসপোর্ট দেওয়া হয়। আমাদের মতো সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের বাধ্য হয়ে দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়।’

শিক্ষক মাহবুবুল ইসলাম সাগর বলেন বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসের সহকারী হিসাবরক্ষক আশরাফ আলী দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ। তাকে টাকা দিলে সেসব করে দিতে রাজি। অন্যথায় যে কারো সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ এবং ভোগান্তিতে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেন না।

তবে এসব বিষয়ে সহকারী হিসাবরক্ষক আশরাফ আলী বলেন, ‘আপনার কোনো কাজ থাকলে দেন, না-হয় বেরিয়ে যান।’ সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেন এমন আচরণ করেন জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন তিনি। একপর্যায়ে উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আপনাকে আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। উত্তর না দিলে আপনি ৪০ বছরেও আমার কিছু করতে পারবেন না। অনেক জায়গায় চাকরি করেছি, আপনার মত অনেক সাংবাদিক যারা আমাকে এসব প্রশ্ন করেছে তাদের আমি প্রথমে সুযোগ দিয়েছি আর বেশি গভীরে যেতে চাইলে তাদের দমাতে ১৪ সিকে ভরে দিয়েছি। আর চাকরির ব্যাপারে বলছেন! রিপোর্ট ছাড়া আর কোনো কিছু করার ক্ষমতা আপনাদের নেই, আমরা এখানে যা করি অথবা যা কামাই, যা খাই তা এ অফিসের সবাই জানে, কাকে কাকে কীভাবে থামাতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি। আর আপনার রিপোর্ট প্রকাশিত হলে আমার চাকরি চলে যাবে ভাবছেন, তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কারণ চাকরি আমি ১২০ বার ছেড়ে দিতে চাই, আপনি যদি পারেন যা খুশি লেখেন। আমার কিছুই করতে পারবেন না।’

এ বিষয়ে জানতে কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক আইরিন পারভীন ডালিয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধŸতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই দিন সাংবাদিক এসে ভিডিও ধারণ করছিলেন। তখন আনসার ও পুলিশ তাকে বলেছেন, উপপরিচালকের অনুমতি নিয়ে ভিডিও করতে। উপপরিচালক সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পেয়ে তার নির্দেশে সাংবাদিককে কক্ষে আনা হয়। কী সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করবে জিজ্ঞেসা করা হয়। কিন্তু অপমান-অপদস্থ করা হয়নি। আর কখনো অফিসে আসতে না দেওয়ার কথাও বলা হয়নি।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে আশরাফের ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে ও স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত সব অফিস দুর্নীতিমুক্ত করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close