মো. জাহিদুল ইসলাম

  ০৮ মার্চ, ২০২৪

মোসাম্মৎ সাগরিকা

শ্রমিক থেকে সেলিব্রেটি

নিঃসন্দেহে সাগরিকা নামটি লাস্যময়ী। ঠাকুরগাঁওয়ের এ কন্যার নামে ভারত ও বাংলাদেশে দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বাংলা সিনেমায় সাগরিকাকে উদ্দেশ করে একটি গানও আছে, ‘আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে, আমি ছুঁয়েছি তোমায়, প্রজাপতি ছুঁয়েছে ফুল, তুমি ছুঁয়েছ আমায়, সাগরিকা বেঁচে আছি, তোমারই ভালোবাসায়...’ এটি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। ‘সাগরিকা’ নামের অর্থ সাগরের বেলা, সমুদ্রের মেঘ।

এছাড়া সাগরিকা নামের অন্য প্রতিশব্দ হলো সমুদ্র, প্রশংসনীয়, মহান, প্রাচুর্য, অতুলনীয় ইত্যাদি। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সাগরিকা নামের একটি স্থান আছে। সাগরিকা এক্সপ্রেস বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল দ্বারা পরিচালিত যাত্রীবাহী ট্রেন। এছাড়া ভারতে ‘সাগরিকা’ ডুবোজাহাজ থেকে উৎক্ষেপিত হয় ক্ষেপণাস্ত্র! সাগরিকা নামের এত উপমা দেওয়ার একটিই কারণ- বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় নারী ফুটবল দলে এ নামে একটি ‘ক্ষেপণাস্ত্র’ আছে! যার নৈপুণ্যে কমলাপুর স্টেডিয়ামে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের বিপক্ষে যৌথ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে ৪ গোল করে সেরা গোলদাতা হন সাগরিকা।

অথচ ফুটবল খেলার অপরাধে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন বাবা। অনেক দিন কথাও বলতেন না। বাবাকে অনেকবার ফোন করেও কথা বলার সুযোগ হয়নি। গ্রামের লোকেরা আবার অনেকে বাজে কথা বলেছেন। বাবা-মায়ের অবাধ্য মেয়েটি আজ দেশের পতাকা অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। সত্যি, মানুষ চাইলে কি না পারে, তার একটি উদাহরণ হয়ে রইলেন দরিদ্র কৃষক বাবার মেয়ে মোসাম্মৎ সাগরিকা। সাগরিকার গোলে দর্শকরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন, তা শুরুতে কল্পনায়ও ভাবেননি বাবা-মা। ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে মেয়ের পারফরম্যান্স দেখে তো মাঠের খেলা শেষে এক আনন্দমুখর পরিবেশের অবতারণা হয়। বাবা-মা দুজনকে জড়িয়ে ধরে মেয়ের আনন্দাশ্রু ঝরে।

বাংলাদেশের ফুটবলে এখন পরিচিত নাম সাগরিকা। টুর্নামেন্টের আগে-পরে কেমন পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে সাগরিকা বলেন, ‘টুর্নামেন্টের আগে সাগরিকাকে কেউ চিনত না। এখন অনেকে চেনে।’ সাগরিকা জানান, ‘যখন ফুটবলে এসেছিলাম, তখন কিছুই ভাবিনি। তবে ইচ্ছা ছিল সুযোগ পেলে কিছু একটা করব। তবে সত্যি বলতে, এত কিছু এত দ্রুত আমার জীবনে ঘটে যাবে, এমনটা ভাবিনি। প্রথম ম্যাচে গোল পাওয়ার পর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল।’ তিনি ভাবছেন সবাইকে নিয়ে, ‘আমার উঠে আসার পথটা খুব কঠিন ছিল। অনেক মেয়ে খেলতে চায় না চোট পাওয়ার ভয়ে, কিন্তু আমি খেলতে চেয়েছি। আমাদের ওখানে অনেক গরিব মেয়ে আছে। তাদের যদি সহযোগিতা করা যায়, তাহলে তারাও আমার মতো উঠে আসার পথ পাবে।’

সাগরিকার মনে জন্ম নিয়েছে নতুন একটি স্বপ্ন। বাংলাদেশের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন মালদ্বীপ আর ভারতের লিগে খেলেছেন। এছাড়া সানজিদা খাতুন প্রথম বিদেশি নারী ফুটবলার হিসেবে কলকাতার ইস্ট বেঙ্গলে যোগ দিয়েছেন। গোল করে গড়েছেন ইতিহাস। এছাড়া কৃষ্ণা রানী সরকারের অভিজ্ঞতা আছে ভারতীয় লিগে খেলার। সিনিয়রদের পথ ধরে সাগরিকরা খেলতে চান বিদেশে কোনো ক্লাবে। তিনি জানান, ‘ইচ্ছে আছে ভবিষৎ দেশের বাইরের লিগে খেলার। যদি সুযোগ পাই, অবশ্যই খেলব। সাবিনা আপু, সানজিদা আপুদের মতো বাইরেও দেশের প্রতিনিধিত্ব করে লাল-সবুজের পতাকা উঁচিয়ে ধরতে চাই।’

অথচ ঠাকুরগাঁওয়ের লাজুক এ মেয়েটির ফুটবলে আসারই কথা ছিল না। বাবা লিটন আলী দরিদ্র এক চায়ের দোকানদার। তিনি ও তার স্ত্রী চাইতেন না ফুটবল খেলুক সাগরিকা। কেননা গ্রামের লোকজন ফুটবল খেলাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখত। কিন্তু সাগরিকার এক খালার জেদ ও ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তাজুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সাগরিকা শেষ পর্যন্ত ফুটবলের পথেই হাঁটতে সক্ষম হন। বর্তমানে দুর্দান্ত ফুটবল খেলে মা-বাবার ভুল ভেঙে দিয়েছেন সাগরিকা। সমুচিত শিক্ষা দিয়েছেন গ্রামবাসীকেও। লজ্জিত গ্রামবাসী এখন সাগরিকার খেলা দেখে বরং গর্ব করেন! দারিদ্র্র্যের কষাঘাতে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি সাগরিকা। বরং একসময় পরিবারের অন্ন জোগাতে ইটভাটাতে শ্রমিকের কাজও করতে হয়েছে তাকে!

২০২৩ সালে সিঙ্গাপুরে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের খেলেন সাগরিকা। করেন ১ গোল। নারী ফুটবল লিগে ভালো খেলার পুরস্কার পান লাল-সবুজ জার্সিতে খেলে (এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয়ে খেলেন, সেবার লিগে করেন ১০ গোল)। বাংলাদেশ দ্বিতীয় পর্বে উঠলে ভিয়েতনামে গিয়েও খেলেছিলেন। গত বছর কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনূর্ধ্ব-১৭ নারী সাফে ওই আসরেও ভুটানের বিপক্ষে ১ গোল করেন সাগরিকা। তার খেলায় মুগ্ধ কোচ টিটু। জুনিয়র ফুটবলে বর্তমানে তুরুপের তাস বলা হয় সাগরিকাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close