খেলা প্রতিবেদক
সোনালি আলো
আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের গল্প
ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন উল্লেখ করার মতো শক্তি। আমাদের অতীত ক্রীড়াঙ্গনও গৌরবের। এখানে অনেক প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ এসেছেন যারা নিরলস শ্রম, অধ্যবসায় এবং মেধা দিয়ে নিজেরা হয়েছেন আলোকিত, বিশ্বের দরবারে দেশকে করেছেন সম্মানিত। নতুন প্রজন্মের অনেকেরই হয়তো এটা জানা নেই। আবার বিস্মৃত হয়েছেন কেউবা। তাদের জন্যই দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের বিশেষ ধারাবাহিক আয়োজন ‘সোনালি অতীত’। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের গ্রেটদের আরেকবার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্র্রয়াস আমাদের। আজকের আয়োজন আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ-
খেলাধুলার ইতিহাসের সেরা দ্বৈরথ কোনগুলো? আপনি হয়তো বলবেন ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ, অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ, ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মহারণ কিংবা রিয়াল-বার্সার ‘এল ক্লাসিকো’র কথা। কিন্তু আপনি কী জানেন! আমাদের দেশেও ক্রীড়াঙ্গনেও ছিল এমন বারুদে ভরা দ্বৈরথ। একটা সময় ছিলো যখন আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল বললেই পুরো দেশ দু ভাগে ভাগ হয়ে যেতো। মাঠে এবং মাঠের বাইরে চলত সমান লড়াই। এমনকি এই দুই দলের খেলাকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে গেছে। শেষদিকে ক্রিকেটেও এই লড়াইয়ের প্রভাব পড়েছিল।
তবে দিন বদলেছে অনেক। আবাহনী-মোহামেডানের সেই দ্বৈরথ আর নেই। ফুটবলের মাঠের সেই পাগলাটে দর্শকও আর নেই। তবে রয়েছে গেছে কিছু ইতিহাস।
আশির দশকের শেষ দু’এক বছর থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফুটবল তখন এক মহা উন্মাদনার নাম। সেসময়ে মোহামেডান ও আবহনী এ দুটি প্রধান দলের পেছনেই ছিল শতকরা ৯০ ভাগ সমর্থক। তাদের লড়াই ছিল খুব মর্যাদাপূর্ণ।
দু’দলের সাফল্যের মূল নিয়ামক ছিল মর্যাদাপূর্ণ এই লড়াইয়ের ফলাফল। কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান অবস্থা। তখনকার ফুটবলারদের মানও ছিল অনেক উন্নত। মোহামেডান দলে তখন খেলতেন কায়সার হামিদ, বাংলার ম্যারাডোনা খ্যাত সৈয়দ র¤œম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, কানন, নকিব, জনি, জুয়েল রানা, মানিক, পনিরসহ দেশবিখ্যাত সব খেলোয়াড়। বিদেশি খেলোয়ারদের মধ্যে ছিল এমেকা, নালজেগার, নাসের হেজাজী, রাশিয়ান রহিমভ, ইরানিয়ান আরেক সুপারস্টার ভিজেন তাহিরি। এসব কুশলী পে¯œয়ারদের ক্রীড়ানৈপুণ্য ছিল সত্যিই দেখার মতো। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যšত্ম পরপর তিনবার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান হয়ে ‘আনবিটেন হ্যাটট্রিক’ করার অনন্য রেকর্ড গড়ে সাদা-কালো জার্সিধারীরা।
ওদিকে আবাহনীতে তখন খেলতেন দেশ সেরা ডিফেন্ডার মোনেম মুন্না, দেশসেরা স্ট্রাইকার আসলাম, গাউস, রেহান, এফ আই কামাল, মহসিন, র¤œপুসহ আরো অনেকে। বিদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন ইরাকের বিশ্বকাপ স্কোয়াডের দু খেলোয়াড় করিম মোহাম্মদ ও সামির সাকির, শ্রীলংকার লায়নেস পিরিচ, পাকির আলী, প্রেমলাল, রাশিয়ান দজমরাভ ইত্যাদি। তারা ৮৪, ৮৫ ও ৮৬ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপা লাভ করে। ১৯৮৯-৯০ সালে ভারতের গেরিলায় নাগজি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে এবং ১৯৯৪ সালে কলকাতায় চার্মস কাপ ইনভাইটেসন কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও আবাহনী ১৯৯১ সালে দুই বাংলার সেরা ছয় দল ভারতের ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান, মোহামেডান (কলিকাতা), বাংলাদেশের মোহামেডান, ব্রাদার্স, আবাহনী) নিয়ে অনুষ্ঠিত বিটিসি ক্লাব কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসে।
ফুটবলের লড়াই মাঝে মাঝে গ্যালারিতেও নেমে আসত। গ্যালারি তখন হয়ে উঠত উন্মত্ত, রণক্ষেত্র। নিজ দলের পরাজয় হলে স্টেডিয়াম এলাকায় প্রায়ই প্রলয় ঘটে যেত। মারামারি, দৌড়ানিতে গোটা এলাকা রণক্ষেত্র হয়ে উঠত। সেই সময়ে ঢাকায় একটা গল্প প্রচলিত ছিল। গল্পটি হলো, কোন এক নতুন দর্শক-সমর্থক গ্যালারিতে বসে আরামসে খেলা দেখছেন। হঠাৎ প্রিয় দলের গোলে গলা ছেড়ে ‘গো-ও-ও-ওল’ বলে চিৎকার করে পড়ে গেলেন মহাবিপদে। আসলে না জেনেই তিনি বিপক্ষ দলের গ্যালারিতে বসেছিলেন।
আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে এরকম বহু মিথ আর গল্প এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বাংলাদেশের ফুটবলকে এগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এই দুই দলের দ্বৈরথকে আবারো ফিরিয়ে অনেক জরুরি।
"