ক্রীড়া প্রতিবেদক

  ৩০ মে, ২০১৯

ক্রিকেট মহাযজ্ঞের বর্ণিল উদ্বোধন

নাচে-গানে-বিনোদনে রাঙিয়ে রাখা হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সমাহার ঘটানো হয় ক্রিকেটের সঙ্গে সংগতিপূণর্,

নানা বৈচিত্র্যময় খেলাধুলা ও কসরতের

২৯ মে ২০১৯। উদ্বোধন আয়োজন প্রলম্বিত করা হয়নি। নাচ-গান-ফায়ারওয়ার্ক-ক্রিকেট ঐহিত্য যা যা প্রয়োজন ছিল তার সবটাই। প্রতীক্ষার চাদর সরিয়ে শুরু হয়ে গেল ১২তম বিশ্বকাপ ক্রিকেট মহাযজ্ঞ। ১০ দলের এই আসরকে ঘিরে আলোচনা এখন আকাশ ছুঁই ছুঁই। দীর্ঘ দেড় মাস ক্রিকেটপ্রেমীরা বুঁদ হয়ে ক্রিকেটের রং-রূপ-মাধুর্য অবগাহন করবে। বাংলাদেশের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও রাতজাগা প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। জয়-পরাজয়ের আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে মিলবে দুঃখ-কান্নার আবিরও।

ক্রিকেট বিশ্বকাপের জমাট উদ্বোধন হয়েছে বাকিংহাম প্যালেসের মলে। এখানে জড়ো হয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখেছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। উপস্থিত ছিলেন ক্রিকেটের পুরোনো-নতুনদের অনেকেই। বাংলাদেশ সময় রাত ১০-১১টা পর্যন্ত প্রাসাদের মলে ভাগ্যবান মাত্র ৪ হাজার দর্শক পেয়েছেন সরাসরি আয়োজন উপভোগ করার সুযোগ। নাচে-গানে-বিনোদনে রাঙিয়ে রাখা হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ক্রিকেটের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নানা বৈচিত্র্যময় খেলাধুলার সমাহার ঘটানো হয়েছে। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপের উদ্বোধনের মতো যাতে সমালোচিত না হয়; সেই কারণে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এছাড়া বিশ্ব টিভির কল্যাণে সরাসরি দেখেছে উৎসবমুখর উদ্বোধন। বিভিন্ন ভেন্যু ঘিরে শহরগুলো নানা রঙে-বর্ণে সাজানো হয়।

উৎসব নিয়ে আগে ভাগেই প্রস্তুত ছিল ক্রিকেট কুলিন দেশ ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডে এর আগে পাঁচবার বিশ্বকাপ আয়োজন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য একবারও শিরোপা ঘরে তুলতে পারেনি। তবে এবারের ১২তম আসরে তারাই টপ ফেভারিট। তাই বর্ণিল জমজমাট উদ্বোধন করতে একটুও ঘাটতি ছিল না তাদের। উল্লেখ্য, এর আগে ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৩ এবং ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়।

নতুন ফরম্যাটের বিশ্বকাপ

নতুন ফরম্যাটের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরের ৩০ মে আনুষ্ঠানিক পর্দা উঠলেও বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ২ জুন। প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ ২৬ মে পাকিস্তানের সঙ্গে অনুশীলন ম্যাচটি খেলতে পারেনি। বৃষ্টি এসে বাধ সেধেছে। ২৮ মে; প্রতিপক্ষ ভারতের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে ছন্দ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ। ভারতের ৩৫৯ রানের জবাবে বাংলাদেশ ২৬৪ রান। হেরেছে ৯৫ রানে। এই ম্যাচে ছিল না তামিম ইকবাল। মাশরাফি থেকেও ছিলেন না ম্যাচে। ফলে বিশ্বকাপের প্রস্তুতিটা যুতসই হয়নি।

আজ ৩০ মে থেকে গড়াচ্ছে সরাসরি মাঠের লড়াই। চলবে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। লর্ডসে অনুষ্ঠিত হবে আসরের ফাইনাল। এবার আসরে মোট ৪৫টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে রাউন্ড রবিন লিগে। বাকি তিনটি হবে সেমিফাইনাল; ফাইনাল। ১০ দলের আসরে প্রতিটি দল একে-অপরের মুখোমুখি হবে। গ্রুপ সেরা চার দল খেলবে সেমিফাইনালে। পরিসংখ্যান বলছে, এর আগে ১৯৯২ সালে এই ফরম্যাটে বিশ্বকাপ ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ১২ বা ১৪ দলের পরিবর্তে ১০ দল নিয়ে বিশ্বকাপের আসরের আয়োজন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ১১তম ক্রিকেট উৎসবটিও যৌথভাবে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়। এবারও তাই ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ওয়েলস। মোটে ১১টি ভেন্যুতে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হবে।

এবার আসরে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকেই শিরোপার প্রধানতম দাবিদার ভাবা হচ্ছে। তাদের পর নাম উঠেছে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার। পরিসংখ্যানও সেই কথা সরবে বলছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত নিষ্কণ্টক পরিসংখ্যানে ৩৫ ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের জয় ২৪টিতে। ৩৩ ম্যাচে ভারতের জয় ২২টিতে। শ্রীলঙ্কার দেড় বছরে ২৬ ওয়ানডে খেলে জিতেছে মাত্র ছয়টিতে ম্যাচে। বাংলাদেশ খেলেছে দুটি ত্রিদেশীয় সিরিজ আর এশিয়া কাপ। তিনটি টুর্নামেন্টেরই ফাইনালে উঠে শিরোপা জিতেছে একটিতে। বাংলাদেশ ২৭ ম্যাচ খেলে জিতেছে ১৭টি। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী দল হিসেবে তৃতীয় ধারাবাহিক দল বাংলাদেশ। তাই অনেকেই ‘নতুন’ শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশকে নিয়ে আশাজাগানিয়া স্বপ্ন দেখছেন।

ফিরে দেখা ক্রিকেট ফিরে দেখা ইতিহাস

দীর্ঘকাল আগে যাত্রা শুরু করেও ক্রিকেট কিন্তু যুগের পর যুগ চলছিল গন্তব্যহীন পথে। ক্রিকেটা আটকে ছিল বিত্তবানদের হাতে। বিত্তহীনদের কাছে ক্রিকেট ছিল মধুর ছলনা। এলিট শ্রেণির ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে ‘নিম্ন শ্রেণি’র কেউ কেউ পরিস্থিতির কারণে কখনো-সখনো স্বাদ পেয়েছেন কথিত এই খেলাটির। ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে জিম্মাদার থাকার সময় এটিকে খেলা হিসেবে ভাবা যায়নি। কখন খেলার পরতে পরতে ছিল নিজেদের জাহির করার দম্ভ। যদিও সাদা পোশাককে বানানো হয় কেতাদুরস্ততার প্রতীক। অথচ শুভ্রতার আড়ালে জড়িয়ে ছিল রাশি রাশি পাঁক। পুরোটাই ছিল শ্বেতাঙ্গদের মনিবসুলভ অহমিকার প্রকাশ। মনোভাবটা ছিল এমন, যারা ক্রিকেট খেলে, তারা সমাজের উপরতলার মানুষ। অন্যরা অস্পৃশ্য। এভাবে পেরিয়ে যেতে থাকে যুগের পর যুগ। ক্রিকেটে সময়টা যেন থমকে থাকে। তবে ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া প্রথম টেস্ট ম্যাচ আয়োজন খেলাটাকে জাতে উঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯২৮ সালের ২৩ জুন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল আর ১৯৩২ সালে ২৫ জুন ভারতীয় উপমহাদেশ জড়িত হওয়ার পর সীমিত পরিসরের ক্রিকেটের ব্যাপ্তি যায় বেড়ে। অন্তত জনসংখ্যার অনুপাতে ভালো একটি অবস্থান গড়ে নেয়। তারপরও কিন্তু ক্রিকেট পালে তেমনভাবে হাওয়া লাগতে দেখা যায়নি। মূলত বিলাতি ঘরানার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে ক্রিকেট। ক্রিকেটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি, যেদিন অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের মধ্যে মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম সীমিত ওভারের এক দিনে আন্তর্জাতিক ম্যাচ। টেস্ট ক্রিকেটের ধ্রুপদি ঘরানা থেকে জন্ম নেয় ওয়ান ডে ক্রিকেটের জনপ্রিয় ধারা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে আসে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ।

ক্রিকেটের আসরের বিশ্বায়ন

ক্রিকেটকে পেশাদার ও রংদার করে তোলার কৃতিত্ব অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চ্যানেল নাইনের অধিপতি ও ধনকুবের ক্যারি প্যাকারের। ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট’ আয়োজন করে তিনি ধাক্কা দেন প্রচলিত ক্রিকেট কাঠামোকে। প্রকৃত অর্থে তিনি ক্রিকেটে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। যথার্থ কারণেই তাকে বলা হয় ক্রিকেট বিপণনের সেলসম্যান। ক্রিকেট বিনোদনের এই কুশীলবের কারণে ক্রিকেটারদের হাতে আসে অঢেল অর্থ। রঙিন পোশাক, ফ্ল্যাড লাইটে খেলা আর বর্ণিল সব আয়োজনে বদলে যায় ক্রিকেটের খোলনলচে। ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত চ্যাম্পিয়ন হলে ক্রিকেটের নতুন সেøাগান যুক্ত হয়। আর পালাবদলের পালায় এক যুগে আগে ক্রিকেটে আসে রীতিমতো বিস্ফোরক পরিবর্তন। প্রবর্তন করা হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট।

ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-এর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন হতে পারছে না। ফিফা যেখানে পুরো বিশ্বকে তাদের ছাতার তলে নিতে পেরেছে, সেখানে আইসিসি একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে আছে। এত দিন না হয় ফুটবলের গতিময়তার সঙ্গে টেস্ট ও ওয়ান ডে ক্রিকেট পেরে উঠেনি। এখন তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এসেছে দুরন্ত গতি। বলে বলে বাউন্ডারি মারার তাগিদ। তাহলে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়াটা খুব একটা কঠিন নয়। কিন্তু আইসিসির এলিটীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্রিকেট বৃত্তের বাইরে যেতে পারছে না।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রস্তুতি

অর্জনের রেকর্ডবুকে বাংলাদেশের আরেকটি নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে। বহুজাতিক আসরে শিরোপা জয়ের কষ্ট শেষ। বিশ্বকাপ ক্রিকেট মিশন শুরুর আগে ক্রিকেট পাগল বাঙালিদের কাছে এটি এক বড় প্রাপ্তি। আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি ক্রিকেটের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলও এক ফুৎকার উড়ে গেছে বাংলাদেশের কাছে। উদ্বেলিত-উজ্জীবিত বাংলাদেশকে ঘিরে নতুন স্বপ্নের ঘুড়ি উড়তে শুরু করেছে।

২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ। আর মাশরাফির অধীনে গত দেড় বছরে ২৭ ওয়ানডের ১৭টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। এ সময় বিবেচনায় দল হিসেবে তৃতীয় বাংলাদেশ। তাদের উপরে রয়েছে ইংল্যান্ড আর ভারত। উল্লেখ্য, সদ্য প্রকাশিত আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপে এক নাম্বার অলরাউন্ডার হিসেবে খেলছেন। তাকেই নিয়ে বাজি ধরতে চান কোচ স্টিভ রোডস। বলেছেন, ‘সাকিব তুমি দেখিয়ে দাও; তুমি কি পারো।’

শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুই দফা হারিয়ে বাংলাদেশ শতভাগ আত্মবিশ্বাস নিয়েই বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেছে। এক্সপার্টরা মাশরাফির বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখছেন। ত্রিদেশীয় সিরিজে পেসারদের গুঁড়িয়ে-উড়িয়ে হুক-পুলের অভিজ্ঞতা ইংলিশ কন্ডিশনে খুব কাজে লাগবে। ওয়ানডেতে তামিম-মাশরাফি-সাকিব-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর পাশাপাশি লিটন-সৌম্য-মোসাদ্দেক-মিরাজ-জায়েদের উপরও এখন নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ। ফলে অভিজ্ঞতা আর সৌরভময় তারুণ্যদীপ্ত ইস্পাত দৃঢ় মানসিকতায় বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে অপ্রতিরোধ্য।

বাংলাদেশের গল্প; গল্পের বাংলাদেশ

দুর্দান্ত নৈপুণ্যে ভাস্বর বাংলাদেশ এখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যেই বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপ খেলাই ছিল স্বপ্নারাধ্যের মতো। সেই বাংলাদেশই এখন অনেকের কাছে নতুন ‘শ্রীলঙ্কা’। ঠিক ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার অবিকল দল বলার চেষ্টা করছেন। নতুন ফরম্যাটের বিশ্বকাপ আসরে বাংলাদেশের সেমিফাইনাল নিশ্চিত এ হেন কথা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টার করেছেন ক্রিকেটবোদ্ধারা। এমন কী পঞ্চম বিশ্বকাপেই শিরোপা জয়কে অসম্ভব দেখছেন না কেউ কেউ।

ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার অনিল কুম্বলে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে দারুণ খেলছে। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আলাদাভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশ্বকাপে এবার অন্য রকম বাংলাদেশকে দেখা যাবে। ধারাবাহিকতা থাকলে তাদের সেমিফাইনাল খেলা নিশ্চিত।’

ভারতের সাবেক ওপেনার ও ধারাবিশ্লেষক আকাশ চোপড়া বলেছেন, এশিয়ায় ভারতের পর দাপুটে দল হিসেবে এখন পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশকেই মনে করে ক্রিকেটপ্রেমীরা। আমার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ নকআউট পর্বে উঠবে; মানে সেমিফাইনাল খেলবে।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল মাশরাফির বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার প্রচ্ছন্ন ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। ঠিক শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশ দলে এখন শুরুতে ঝুঁকি নেওয়ার মতো ক্রিকেটার আছে, আছে তাদের সামর্থ্যও। আবার পরে ধরে খেলার ক্রিকেটারের সংখ্যাও কম নয়। এবারের বাংলাদেশ বিশ্বকাপে যেকোনো দলকেই ভড়কে দিতে পারে।’

আর বাইরে থেকে বাংলাদেশ দলের শক্তি হয়ে দারুণ বোলিং-ব্যাটিং-ফিল্ডিং করছেন কোচ স্টিভ রোডস। তার মন্ত্রের উজ্জীবনী সুধা পান করে সিনিয়র-জুনিয়র সব ক্রিকেটাররাই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করছেন। প্রথমবারের মতো ওয়ানডে টুর্নামেন্টের শিরোপাজয়ী দলের কোচ স্টিভ রোডস মনে করেন, পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারের বাইরেও বাংলাদেশ শক্তি সঞ্চয় করেছে।

কৌশল-মেধায় বদলে যাওয়া বাংলাদেশ

বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরে তামিমকে অনেকেই তুরুপের তাস মনে করছেন। কারণ তিন জাতি ক্রিকেটে ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে অভ্যস্ত তামিম ইকবাল পুরো সিরিজেই উচ্চাভিলাসী শটের আহ্বানে হকচকিয়ে যাননি। বরং প্রান্তসখাকে ব্যাটিংয়ের কীভাবে নিখাদ জৌলস দেখাতে হবে সেই মন্ত্র পাঠ করিয়েছেন। নিজে ক্রিজ আঁকড়ে রেখে অন্যকে নির্বিঘœ ব্যাটিং করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তামিম আকাশমুখী-বিলাসী স্বপ্ন-সাধনার ব্যাটিং না করে সংগ্রামী ব্যাটিং করেছেন। তামিমের এই নতুন রূপ বাংলাদেশের পূর্বের ন্যুজব্যাটিং বাতাবরণে ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করেছে। তামিম যুতসই সঙ্গ দিয়েছেন, প্রয়োজন ছক্কা-চারও মেরেছেন। কিন্তু আগ্রাসী হননি। ফলে সৌম্য-লিটনরা হাতখুলে খেলেছেনও। তাদের ব্যাটিং আলোতে ক্রিকেটের রূপ-রস-মাধুর্য-রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়েছে আয়াল্যান্ডের ডাবলিনের প্রতি ইঞ্চি সবুজ ঘাসে। সবমিলিয়ে এই আসরে বাংলাদেশের আশা জাগানিয়া পারফরম্যান্সে সম্মোহিত হয়েছেন ক্রিকেটবোদ্ধারা।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে টার্গেট

বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে কেটেছে শিরোপা জয়ের অর্বাচীন গেরো। গত এক যুগে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ছয়-ছয়টি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেও শিরোপা জিততে পারেনি বাংলাদেশ। অবশেষে সেই অনামিশার আঁধার কেটেছে। বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতিটা দারুণ এবং সুচারুভাবেই সম্পাদন করেছেন মাশরাফিরা। টোটাল দল হিসেবে বাংলাদেশের ড্রেস রিহার্সসোসের আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। এই আসরে ওপেনিং সংকট থেকে পরিত্রাণ, রান তাড়া করে জয়, চাপের মধ্যেও সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার কৌশল, আশাজাগানিয়া ব্যাটিং এবং সবমিলিয়ে পেশাদার টিম বাংলাদেশ হয়ে উঠার প্রেরণা পেয়েছে। রান চেইজের চাপ; কিংবা পরিস্থিতি সামলানোর চাপÑ এই দুই চাপই কাঁধে নিতে পারে বাংলাদেশ। হার এড়িয়ে জয়ও জিনে নিতে শিখেছে মাশরাফিরা। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরে একটি চাপ-ভারমুক্ত ‘টিম বাংলাদেশ’ পাচ্ছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।

দীর্ঘ দেড় মাসব্যাপী বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরে এবার ১০ দলের সবাই একে অন্যের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। পয়েন্ট টেবিলের সেরা চার উঠবে সেমিফাইনালে। টাইগারদের প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের আটটি ভেন্যুতে ঘুরে ঘুরে বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্বের ৯ ম্যাচ খেলবে মাশরাফি-সাকিবরা। সেখানে স্বপ্ন-সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। ‘বাংলাদেশ সেমিফাইনালও খেলতে পারে’ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের এই মুখবাক্যকে লাল-সবুজের অনুরাগীরা স্পটলাইন হিসেবে ধারণ করে বসে আছে।

ক্রিকেট মানেই হিসেবি খেলার বিশুদ্ধ মহড়া। ধারাবাবিহকার জন্য প্রয়োজন হয় বোলিং-ব্যাটিংয়ের যুগলবন্দির আত্মিক বন্ধন। মাঠে প্রয়োজন হয় বুঝাপড়ার গাণিতিক সমীকরণ। আয়ারল্যান্ডে এর সবটাই প্রতিভাত হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাটিং-বোলিংয়ে প্রদর্শিত প্রতিভা মুগ্ধতা ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। যার সুরভিত সৌরভ ছড়িয়ে পড়িয়ে ইংল্যান্ডের আনাচে-কানাচে। সঙ্গে গত বিশ্বকাপে ভারতের কাছে হারের প্রতিশোধের স্ফূলিঙ্গটা বুক-পাজরে লেপ্টে আছে। ক্ষতের মতো কষ্ট সমুদ্রে ঢেলে দিচ্ছে। অনেকেই মনে করেছেন তাই এবার বাংলাদেশকে ঘিরে সম্ভাবনায় আলোক রশ্মি জ্বল জ্বল করছে। পুরোনোদের সঙ্গে শুরু হয়েছে নতুন ক্রিকেটারদের জয়গান। তাই বিশ্বকাপে এবার এক উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন রঙিন অধ্যায় দেখার সম্ভাবনা থাকছেই। জয় হোক লাল-সবুজের বাংলাদেশের প্রতিদিন প্রতি ম্যাচে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close