গাজী শাহনেওয়াজ

  ০২ এপ্রিল, ২০২৪

এনআইডিতে ওটিপি ঘিরে ভূতুড়ে কাণ্ড

অন টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) কাণ্ডে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ঘিরে চলছে ‘আষাঢ়ে গল্প’। লগইন ছাড়াই চলে আসছে ব্যক্তির ব্যক্তিগত মোবাইলে ওটিপি। এমন আজগুবি, ভূতুড়ে ও কাল্পনিক উদ্ভাবিত কল্পকাহিনি শোনাচ্ছেন কর্মকর্তারা, যা শুনে বিব্রত ও অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। কিছুদিন ধরেই পুরোনো ইস্যুটির পুনরাবৃত্তি ঘটনায় ‘হুলুস্থুল’ শুরু হয়েছে এনআইডি ঘিরে।

দায় নিতে নারাজ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তার অজান্তেই ঘটেছে এমন অদ্ভুত ঘটনা। তবে ইসির তথ্যপ্রযুক্তি শাখা বলছে, এমন হওয়া অসম্ভব। কারণ অনটাইম পাসওয়ার্ড, যা সাময়িক গোপন পিন কোড। শুধু লগইন করার পর একবারের জন্য বৈধতার স্বীকৃতির জন্য আপনার ব্যক্তিগত নম্বরটিতে আসবে। এটি বিশ্বের সব নামিদামি গবেষক ও বৈজ্ঞানিক দিয়ে তদন্ত করেও রহস্য ভেদ করা যাবে না। তারা আরো বলছেন, আপনি আপনার মোবাইল কম্প্রোমাইজ করে রেখে দেবেন, সেই চোর আপনি ধরবেন কেমন করে। সম্ভব! বলেন, শুধু এটার ক্ষেত্রে না। বিকাশ, রকেট ও নগদ এটার ক্ষেত্রেও ওটিপি আসে। সেটা কিন্তু বলার সুযোগ নেই, আসে নাই। কারণ প্রতিটি ইউজার আইডির জন্য থাকে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়, যা নিজের যোগসাজশ ছাড়া ভেদ করা অকাল্পনিক।

ইসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের এনআইডিতে কর্মরত এক সহকারী পরিচালকের (মহিলা) ইউজার আইডি ব্যবহার করে ৩০০ কিলোমিটার দূরে যশোরের শার্শা উপজেলায় সংশোধন না হওয়ার যোগ্য এমন এনআইডি ত্বরিত সংশোধন হয়ে যায়। একটি-দুটি নয়, একাধারে ৬৩টি আবেদন কর্মকর্তার অজ্ঞাতে নিষ্পত্তি হয়। অস্বাভাবিক এ ঘটনায় হইচই পড়ে যায়, প্রশ্ন উঠেছিল এনআইডির সুরক্ষিত তথ্যভাণ্ডার নিয়ে। পরে সেগুলো রোল-ব্যাক করে আগের অবস্থায় নিয়ে লক করে দেওয়া হয়। তদন্তে কর্মকর্তা নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও তদন্তে তার দায় এড়াতে না পারায় বর্তমানে বরখাস্ত রয়েছে।

বলা যায়, চক্রকারে ঘটছে ঘটনাটি। ফলে ফের ‘হুলুস্থুল’ পড়েছে এনআইডিতে। কারণ কুমিল্লার সাবেক আঞ্চলিক কর্মকর্তা (বর্তমান এনআইডির পরিচালক অপারেশন) ফরহাদ হোসেনের ব্যক্তিগত সেলফোনে ওটিপি আসে। তার দাবি লগইন করেননি অথচ ওটিপি চলে এসেছে। ওই কর্মকর্তা তখন স্টেশনেও ছিলেন না। কীভাবে এই ওটিপি তার ব্যক্তিগত মোবাইলে এলো, তিনি নিজেও জানেন না। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে প্রতিকার চেয়ে এনআইডিতে আবেদন করেন। কথা হয় এ কর্মকর্তার সঙ্গে। প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমি অফিসের প্রয়োজনে অন্য একটি স্টেশনে কর্মরত ছিলাম। ইউজার আইডি লগইন করেনি অথচ ওটিপি দেখে হতবাক হয়ে যায়। এমনটি হওয়ার কথা না। তাই বিষয়টির সুরাহ করার জন্য এনআইডি উইংয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে আবেদন করেছি। শুনেছি তদন্ত চলছে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে ফরিদপুরের সাবেক আঞ্চলিক কর্মকর্তা মো. দুলাল তালুকদারের ক্ষেত্রে। তিনিও দায় এড়াতে এনআইডি উইংয়ে অপরাধী শনাক্তে অভিযোগ পেশ করেছেন। বলেছেন, ‘ওটিপি’ কাণ্ডে তিনি জড়িত নন। এ ঘটনার তদন্ত চলছে। মো. দুলাল তালুকদারকে কয়েক দফা ফোন করা হয়, রিং বাজলেও রিসিভ না করায় মন্তব্য সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ইউজার আইডি ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতসারে একান্ত মোবাইলে চলে আসছে ওটিপি বা সাময়িক গোপন পিন কোডটি। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে প্রতিকার চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এমন ভূতুড়ে কর্মকাণ্ডে বিব্রত ওই কর্মকর্তা। পুরোনো ঘটনাটি ফিরে আসায় অস্বস্তি ও বিব্রত নির্বাচন কমিশনও। তবে ইভিএম তৈরির নেতৃত্বে থাকা বুয়েটের অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবির প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, নিজের অজান্তে ওটিপি আসার কথা না। কর্মকর্তা নিশ্চয়ই বিশ্বস্ত কারো কাছে এটি শেয়ার করেছেন, তা না হলে সম্ভব না। কর্মকর্তারা দায় এড়াতে মিথ্যা বলছেন। এমন আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। শাস্তি পেতে পারেন, তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে। ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, একজনের সংশোধন আরেকজন করে ফেলছে, এটা আমরা বলব অসম্ভব। কারণ এর নাড়ি-নক্ষত্র হাজার গবেষণা করেও বের করা যাবে না। কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার একটি ইউজার আইডি থাকে এবং একটি পাসওয়ার্ড থাকে। এটি লগইন করার পর ব্যক্তিগত মোবাইলে ওটিপি (ভেরিফিকেশন নম্বর) আসে। তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যক্তির অগত্যসারে হওয়া সম্ভব না। বলেন, পাসওয়ার্ডটি না হয়, তর্কের খাতিয়ে ধরেই নিলাম অসাধু চক্র জেনে ফেলল। কিন্তু ওটিপি তো যখন আপনি একক্সেস করবেন বা লগইন করবেন ওই সময়ে আপনার পে-অফ শো করবে বা সতর্ক করবে। আর ওই মোবাইলটা আপনার ব্যক্তিগত।

এ মোবাইল থেকে যদি ওটিসি লিক হয়, তাহলে এটা আপনার ব্যর্থতা। এটার আর কোনো বক্তব্য নেই। বলেন, আমার ঘরে সম্পদ আছে, ঘর যদি অরক্ষিত হয়, এর দায় চোরের না; পুরো দায় আপনার। সবসময় চোরকে দায়ী করতে চাই না আমরা। তিনি বলেন, চোর সৃষ্টি করার জন্যই; কিন্তু আমরাই দায়ী। প্রথমে আপনার ঘর সুরক্ষিত রাখবেন। পরে বিচার করা হবে চোরের। এমন একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে নিতান্তই আপনার, এ জিনিস অন্য কারো না। আপনার মোবাইল ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব না। এটাই ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড।

ইসির সিস্টেম ম্যানেজার আশরাফ হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ওটিপি ছাড়া যেহেতু এনআইডি সংশোধন, নাম কর্তন, নাম অন্তর্ভুক্তির রাস্তা নেই। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সন্দেহ করছে যে অন্য কেউ একক্সেস করছে, এটা আবিষ্কার করা, কোনো দিনই সম্ভব না। এটা ওনিই ভালো বলতে পারবেন। ওনার মোবাইল নিয়ে কে এক্সেস করে। দুনিয়ায় এ জিনিস আপনি কেমনে বের করবেন। আপনি আপনার মোবাইল কম্প্রোমাইজ করে রেখে দেবেন, সেই চোর আপনি ধরবেন কেমন করে। সম্ভব! শুধু এটার ক্ষেত্রে না। বিকাশ, রকেট ও নগদ এটার ক্ষেত্রেও ওটিপি আসে। সেটা কিন্তু বলার সুযোগ নেই আসে নাই।

এনআইডির সাবেক এ সিস্টেম ম্যানেজার আরো বলেন, আর ওটিপি ছাড়া আপনি এনআইডির ডাটাবেজে ঢুকতেই পারবেন না। তদন্ত যতই দেবে, এসব তদন্তের সুরাহ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এটি কি সম্ভব; ওনিই ভালো বলতে পারবেন। আর যদি বলি, ওনার ঘনিষ্ঠজন ছাড়া লিক হওয়ার সুযোগ নেই। আক্ষেপ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, যখন শুনি এনআইডি সংশোধন নিয়ে ঘুষবাণিজ্য চলে, তখন মনটাই খারাপ হয়ে যায়। অনেক পরিশ্রম করি স্বচ্ছতার জন্য। মনে চাই যদি আল্লাহ দুই হাতের পরিবর্তে দশটি হাত দিতেন, তাহলে মানুষকে ওই হাত দিয়েই সাহায্য করতাম। এরপরও যদি শুনি ওমুক জায়গায় পয়সা দিয়ে করতে হয়েছে তখন কষ্ট লাগে। কারণ এটি নিজেদের প্রতিষ্ঠান তো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close