মো. রবিউল ইসলাম, টঙ্গী (গাজীপুর)

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

সুখ শান্তি সমৃদ্ধি কামনা

আখেরি মোনাজাতে শেষ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব

‘হে আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে কুফরি, মুনাফেকি দূর করে দাও। হে আল্লাহ তোমার নির্দেশিত পথে চলার তৌফিক দাও। হে আল্লাহ, আমাদের সব নেক চাহিদা পূরণ করে দাও। হে রাহমানুর রাহিম আমাদের ওপর রহম করো।’- এমন আহাজারিতে আখেরি মোনাজাতে কাঁপল টঙ্গীর তুরাগতীর। মোনাজাতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, মুক্তি, সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনা করে, বিভেদ ভুলে ঐক্যের আহ্বানে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কাকুতিমিনতি জানানো হয়। গতকাল রবিবার সকাল ৯টা থেকে ৯টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা জুবায়ের আহমেদ। এই মোনাজাতের মধ্য দিয়েই শেষ হলো ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব।

নানা ঝক্কি-ঝামেলা উপেক্ষা করে গভীর ভাবাবেগপূর্ণ পরিবেশে ‘আমিন, আল্লাহুমা আমিন,’ ধ্বনিতে টঙ্গীর আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মহামহিম ও দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে অপার করুণা ও রহমত কামনা করে রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশের ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি ছাড়াও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন ৭২ দেশের ৮ সহস্রাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান।

সকাল থেকে দিকনির্দেশনামূলক বয়ানের পর লাখো মানুষের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে সকাল ৯টায়। জনসমুদ্রে হঠাৎ নেমে আসে আবেগঘন পিনপতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তুলেন আল্লাহর দরবারে। আখেরি মোনাজাত ঘিরে গতকাল লাখ লাখ মুসলমান যেন ভেঙে পড়েছিলেন টঙ্গীতে। রাজধানী ঢাকা ছিল প্রায় ফাঁকা। টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, মার্কেট, বিপণিবিতান, অফিসসহ সবকিছু ছিল বন্ধ। এ ছাড়া শিল্পনগরী টঙ্গীর হাজারো বহুতল ভবনের ছাদে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মা ও বোনেরা এ আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। সবার প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লিদের সঙ্গে মোনাজাতে শরিক হয়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। এবার বিশ্বের ৭২টি দেশের ৮ হাজার বিদেশি মেহমান ইজতেমায় শরিক হন।

বাঁধভাঙা গণজোয়ার : আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা টঙ্গী অভিমুখে ছুটতে থাকেন। বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহনকারী লাখ লাখ মুসল্লি ছাড়াও রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার মানুষ ভিড় এড়াতে নানা ঝক্কিঝামেলা উপেক্ষা করে রাতেই টঙ্গীমুখো হয়। দূর-দূরান্ত থেকে আল্লাহপ্রেমী মুসলমানরা রেলপথ, সড়ক পথ, নৌপথসহ বিভিন্ন যানবাহন এবং অনেকে পায়ে হেঁটে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করেন। যতই সময় গড়াতে থাকে, ততই মানুষের ঢল আঁচড়ে পড়তে থাকে তুরাগের তীরে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষের সমাবেশ ঘটে আখেরি মোনাজাতে।

সকাল থেকে সড়কপথে টঙ্গীমুখী সব যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় দীর্ঘ পথ হেঁটে টঙ্গী পৌঁছাতে হয়েছে লাখো মানুষকে। শনিবার মধ্যরাত থেকে নদীপথ, রেলপথ ও যানবাহন শূন্য সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে পায়ে হেটে টুপি পাঞ্জাবী পরা মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার শুরু হয়। চারদিকে যত দূর চোখ যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পনা ধর্মপ্রান মানুষ আর মানুষ। সকাল ৮টার মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তুরাগতীরের পুরো ইজতেমাস্থল ও চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে আশপাশের খোলা জায়গা, বাসাবাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদ ও অলিগলিসহ যে যেখানে পেরেছেন পাটি, চটের বস্তা, খবরের কাগজ বিছিয়ে কা্িক্সক্ষত মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেছেন।

সমাপনী ও হেদায়েতি বয়ান : সকালে ইজতেমার মোনাজাতের আগে বাদ ফজর হেদায়েতি বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক (রাইবেন্ড)। এরপর নসিয়তমূলক বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। তিনি ইমান, নামাজ, আমল, তালিম, এলেম, জিকির, দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরে বয়ান রাখেন। মোনাজাতপূর্ব বয়ানে মাওলানা জুবায়ের আহমেদ সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশে তাবলিগ ও দাওয়াতে মেহনতের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

ফিরতি যাত্রায় বিড়ম্বনা ও যানজট : আখেরি মোনাজাত শেষে মানুষ একসঙ্গে ফেরার সময় সড়ক-মহাসড়কগুলোতে যানজটে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থাটি আখেরি মোনাজাতের পর প্রতি বছরই ঘটে থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। চার-পাঁচ দিন ধরে টঙ্গীতে জমায়েত হওয়া মুসল্লিরা এক যোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরতে চাইলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। হাজার হাজার বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর ও মহিলা মাইলের পর মাইল হেঁটে মোনাজাতে শরীক হন এবং একইভাবে ফিরেন। দুপুরের পর সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

দূরদূরান্তের যাত্রীরা রিকশা-ভ্যান, টেম্পো, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানে চড়ে ভেঙে ভেঙে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিতে দেখা গেছে। অন্যদিকে, টঙ্গী স্টেশনে ফিরতি যাত্রীদের জন্য অপেক্ষমাণ ট্রেনগুলোতে উঠতে মানুষের জীবনবাজির লড়াই ছিল উদ্বেগজনক। ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদে ও দরজা-জানালায় ঝুলে শত শত মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে দেখা যায়। একপর্যায়ে মানুষের জন্য ট্রেন দেখা যাচ্ছিল না।

১৯ মুসল্লির মৃত্যু : গতকাল সকাল পর্যন্ত একজন পুলিশ সদস্যসহ ১৯ জনের মৃত্যু হলো। নিহতরা হলেন রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার সানোয়ার হোসেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারার জলিলের ছেলে আলম, নরসিংদীর নুরুল ইসলামের ছেলে শাহনেওয়াজ (৬০), সিরাজগঞ্জ জেলার ওসমান গনির ছেলে আল মাহমুদ, শেরপুর জেলা সদরের জুগনিবাগ গ্রামের মৃত সমশের আলীর ছেলে নওশের আলী, ভোলা জেলার পরাগগঞ্জ থানার সামানদার গ্রামের বেলায়েত হোসেনের ছেলে আ. কাদের, নেত্রকোনা সদরের কালিয়াঝুড়ি এলাকার হোসেন আহম্মদের ছেলে স্বাধীন, কুমারী বাজার গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে আবদুস সাত্তার, বুড়িঝুড়ি গ্রামের স্বল্পদুগিয়া গ্রামের আবদুুস ছোবাহানের ছেলে এখলাস মিয়া, ভোলা জেলার ভোল্লা গ্রামের নজির আহমেদের ছেলে শাহ আলম, জামালপুর জেলার তুলশীপুর এলাকার পাকুল্লা গ্রামের হযরত আলীর ছেলে মতিউর রহমান, টঙ্গীর বসির মিয়ার ছেলে আবদুল জব্বার। আরেকজনের পরিচয় জানা যায়নি।

ময়দানে আসার সময় মারা যাওয়া ছয়জন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার ধামাউরা গ্রামের ইউনুছ মিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার চৌহদ্দীটোলা গ্রামের জামান মিয়া, পুলিশ সদস্য হাসান উজ্জামান, শেরপুরের আমেলা খাতুন, ঢাকার মিরপুরের মোশাররফ আহমেদের ছেলে মোবাশ্বের আহমেদ। আরেকজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

সড়ক জুড়ে বাজার : গতকাল ভোর থেকে টঙ্গীর প্রায় সব রাস্তা পরিণত হয় বাজারে। এমন কিছু নেই, যা পাওয়া যায়নি এসব বাজারে। ইজতেমাফেরত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দোকানিরা উঁচু গলায় চিৎকার করতে থাকেন ‘হাফ রেট-হাফরেট’ বলে। কম্বল, সোয়েটার, কোট-টাই, শাড়ি, লুঙ্গি, মাছ-মাংস, ডিম, সবজি, গুড়-মুড়ি, আপেল-কমলা থেকে শুরু করে চীনামাটির তৈজসপত্র, হাঁড়িপাতিল, মোবাইল ফোন পর্যন্ত- সবকিছুই বিক্রি হয়েছে।

আয়োজক কমিটির সন্তোষ প্রকাশ : টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বি প্রকৌশলী প্রকৌশলী মাহফুজুল হান্নান জানান, আলহামদুলিল্লাহ কোনোপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এবারের একপক্ষের ইজতেমা সমাপ্ত হয়েছে। ইজতেমার সার্বিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি এই প্রতিনিধিকে জানান, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুসল্লিদের আসতে এবং ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকায় আইনশঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের প্রতি ইজতেমা আয়োজক কমিটির পক্ষে সন্তোষ প্রকাশ করছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close