নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪

১৪ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯ বার

টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৪ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন, বিতরণসহ সব সূচকেই উন্নতি দৃশ্যমান। নানা চ্যালেঞ্জ উতরে দেশের শতভাগ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও আবাসনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। চাহিদা পূরণে উৎপাদন বাড়াতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা যেমন বাড়ানো হয়েছে, তেমনি দফায় দফায় বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে নতুন করে আরো এক দফা দাম বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১২৫টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। তা বেড়ে এখন ১৫২টি হয়েছে। সেসময় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে দেশের ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট। সে হিসাবে গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ২৪ হাজার ৭৮৫ মেগাওয়াট।

গত ১৪ বছরে সঞ্চালন লাইন ৮ হাজার কিলোমিটার থেকে বেড়ে ১৪ হাজার ৯৬০ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এ সময়ে গ্রিড সাব-স্টেশন ক্ষমতা (এমভিএ) ১৫ হাজার ৮৭০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬ হাজার ১৫০ এমভিএ। ১৪ বছর আগে যেখানে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার, সেটি এখন বেড়ে ৬ লাখ ৪৩ হাজার কিলোমিটার। ২০০৯ সালে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন (কিলোওয়াট ঘণ্টা) ছিল ২২০, এখন তা ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২০। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিতরণের সিস্টেম লস ১৪.৩৩ শতাংশ থাকলেও সেটি কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৭.৬৫ শতাংশে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণসহ সব সূচকেই উন্নতি যেমন হয়েছে, একইসঙ্গে এ খাতে সরকারের বরাদ্দের পরিমাণও বেড়েছে কয়েকগুণ। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ছিল ২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে এডিপি বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৪০.৪৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের ঘরে ঘরে সরকারের বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা এবং বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় বাড়তি বরাদ্দসহ সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে এ খাতের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

গত ১৪ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদা যেমন বেড়েছে, এ সময়ে শতগুণেরও বেশি বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯ বার। এ সময়ে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ এবং গ্রাহকপর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৮.৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। একইসঙ্গে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫.৩ শতাংশ। নতুন দাম ওই বছরের মার্চে কার্যকর হয়। পরে আরেক দফা পাইকারিতে দাম বাড়ানো হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে।

সরকারের নির্বাহী আদেশে সর্বশেষ গত বছরের ১২ জানুয়ারি গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। ওইসময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে আবাসিক গ্রাহকপর্যায়ে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ১৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪০ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ৭২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ১ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩০ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ইউনিটপ্রতি ৯ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ইউনিটপ্রতি ১১ টাকা ৪৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৩ পয়সা করা হয়।

তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। তবে নতুন করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। বিদ্যুৎ খাতে ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি কমিয়ে আনার চিন্তা করছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর অর্থনৈতিক চাপের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। শিগগিরই সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার কথা রয়েছে। মার্চে নতুন এ দাম সমন্বয়ের কাজ শুরু হতে পারে। তবে বিদ্যুতের দাম একবারে না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। দাম বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে, তবে কবে নাগাদ বাড়ানো হবে সেটি বলা যাচ্ছে না। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি এমনিতেই বাড়ছে। বাজারে জিনিসপত্রের দামও চড়া। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতির সব খাতেই এর প্রভাব পড়বে। দাম আরো বেড়ে যেতে পারে সব ধরনের পণ্যের। এতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নতুন চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে সরকারকে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন সময়ে যৌক্তিক ব্যয় অপেক্ষা অযৌক্তিক ও অন্যায় ব্যয় সংযোজন হয়েছে। সেই ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সরবরাহ ব্যয় ও ঘাটতি বেড়েছে। আবার ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য ভর্তুকি বেড়েছে এবং মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত ব্যয় সংযোজন হয়েছে। অযৌক্তিক ও অন্যায় ব্যয় সংযোজন থেকে বিদ্যুৎ খাতমুক্ত করতে না পারলে ব্যয় ও ভর্তুকি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং সেটি অবধারিত।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল সব উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে। অতীতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে বিইআরসিকে (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) জানানো হতো। প্রতিষ্ঠানটি গণশুনানির আয়োজন করত। তখন দাম বাড়ানো নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সুযোগ ছিল। এখন আর সেই সুযোগ নেই। এসব বিষয়ে কিছুই জানানো হয় না। বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানোর পরিকল্পনা করতে হবে। কারণ দাম বাড়ালে তার মাশুল গুনতে হবে সাধারণ মানুষকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close