নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪

ওপারে সংঘাত এপারে সতর্কতা

টেকনাফে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত

মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা কক্সবাজারের টেকনাফ এবং বান্দরবানের তুমব্রু এলাকায় কয়েকদিন ধরে গোলাগুলি ও মর্টার শেল ছোড়ার শব্দ শুনছেন স্থানীয়রা। সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের কয়েকটি বাড়ি এবং জমিতে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে বলেও জানান তারা। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, তীক্ষè নজর রাখছে সরকার, সতর্কতা বাড়িয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তুমব্রু ও টেকনাফ সীমান্তে এরই মধ্যে সতর্ক অবস্থানের কথা জানিয়েছে কক্সবাজার এবং বান্দরবানের জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

মিয়ানমারে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির সংঘাত চলছে। দুই সপ্তাহ আগে আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারত সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের দিকে তীক্ষè নজর রাখছে এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে সরকার বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আরাকান আর্মি ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে সংঘাত চলছে। সেই সংঘাতের মর্টার শেল আমাদের দেশে এসে পড়েছে। এটি আমরা অবশ্যই নজর রাখছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সীমান্তরক্ষীরা সতর্ক আছে এবং মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ আছে। আমরা আশা করব সেখান থেকে কোনো মর্টার শেল এখানে আসবে না। আমরা সতর্ক আছি।’

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে খবর পেয়েছি- সীমান্ত এলাকা থেকে রবিবারও কিছু ফায়ারিং হয়েছে। এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘প্রায় প্রতিনিয়ত গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমরা। এ নিয়ে এলাকার মানুষ একটু আতঙ্কিত। ইউএনও-ডিসি আছেন, আমরা সবকিছু তাদের জানাচ্ছি।’ মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটাতারঘেঁষা এই পল্লীতে ২৭টি পরিবারের বাস। এখানকার বাসিন্দারা বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ও গোলাগুলির সময় দুদিন আগে গুলি এসে এই পল্লীতে পড়ে। আতঙ্কে এই পল্লীর বাসিন্দারা রাতে নিয়মিত পাহারা চালু করেছেন। প্রতি পরিবার থেকে রাতে একজন করে জেগে থাকেন, যাতে রাতে ওপার থেকে গুলির ভয়াবহতা শুরু হলে তারা দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারেন।

স্থানীয় সাংবাদিক আজিম নিহাদবলেন,মিয়ানমার অংশে ৩৪ পিলার রাইট ক্যাম্প এবং ঢেকিবুনিয়া ক্যাম্প দুটি স্পষ্ট দেখা যায় বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে। এখনো ওই ক্যাম্প দুটি জান্তা বাহিনীর দখলে দেখা যাচ্ছে, সেখানে বিপুল সেনা সশস্ত্র অবস্থান করছেন।’

উখিয়ার পালংখালি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন বলেন, পালংখালির আনজুমানপাড়া সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চলছে। দুপুরের দিকে দুটি হেলিকপ্টার থেকে গোলা ছুড়তে দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ভয়ে চিংড়ি ঘের ও জমিতে যেতে পারছেন না।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, গত শনি ও রবিবার টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়াগ্রামের নুরুল ইসলামের বসতঘরে এবং সীমান্তের কাছে একটি জমিতে এসে মর্টার শেল পড়েছে।

নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবিসহ স্থানীয়রা সতর্ক রয়েছেন। হোয়াইক্যং উলুবনিয়া জামান সখিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসেন আলী সিকদার বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের কারণে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, নিয়মিত গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন।

কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন ৩৪-বিজিবির অধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘর্ষের জেরে গত ২৭ জানুয়ারি ১৩টি মর্টার শেল এবং ১ রাউন্ড বুলেট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়ে। ওই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সীমান্তের ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু এলাকার ৩৪, ৩৫ ও ৩৬ সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি এলাকায় দুপুর দেড়টার দিকে মিয়ানমারের কিছুটা ভেতরে বিমান বাহিনীর দুটি যুদ্ধ হেলিকপ্টার প্রায় ৩০ মিনিট সময় ধরে উড়াউড়ি করতে দেখা গেছে। ওই সময় কয়েকটি বিস্ফোরণে এলাকা কেঁপে ওঠে। তমব্রু ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছৈয়দুর রহমান হিরা এসব তথ্য জানান।

গতকাল সোমবার বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রি রতন চাকমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের কাছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় একদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এর বড় একটা অংশই পড়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়।

এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার এবং বান্দরবানের স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা একত্রে কাজ করছি। আমাদের তৎপরতা ও সতর্কতা অব্যাহত রয়েছে।’

এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আবারও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করতে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম এবং ইশফাক ইলাহী চৌধুরী মনে করেন, সংঘাতের তীব্রতা বাড়লে, জীবন বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওইসব এলাকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে। যেহেতু আগেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা এসে আশ্রয় নিয়েছে, তারা তাদের পরিচিতজনদের কাছে আশ্রয় চাইতে পারে। এছাড়া এই সংঘাতের প্রভাব শুধু বাংলাদেশ না, প্রতিবেশী ভারতেও পড়ার আশঙ্কার কথা বলছেন তারা। ফের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশমুখী হলে বিপদ আরো বাড়তে পারে বলে মনে করেন তারা।

এদিকে রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওই আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যু।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মিয়ানমারের পরিস্থিতি কখনোই ভালো ছিল না। তবে বাংলাদেশের আশা, পরিস্থিতি ভালো হবে এবং দ্রুতই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে।’ এ রিপোর্ট তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি এবং নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) প্রতিনিধি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close