মিজান রহমান

  ১১ মে, ২০২২

ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষায় তোড়জোড়

চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার ৭০ কিলোমিটার অংশে ৫ শতাধিক ড্রেজার বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করছে একটি চক্র। এ কারণে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও বন্ধ করা যায়নি নদীভাঙন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদীর জীববৈচিত্র্য, ইলিশসহ মৎস্যসম্পদ। তাই এবার ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষায় তোড়জোড় দিয়ে নড়েচড়ে উঠেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা। নদী ও ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষায় করণীয় নির্ধারণ করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বৈঠকে বসেছে। বৈঠকে ইলিশ রক্ষায় চারটি সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি নদণ্ডনদী এবং খাল-বিল দখল ও দূষণকারীদের তালিকা চেয়ে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা-মেঘনার চাঁদপুর অংশে ৭০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ব্যাপক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ইলিশের ডিম পারা ও চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দেখা দিয়েছে মাছের খাদ্য সংকটও। তাই রুট পরিবর্তন করে জাতীয় মাছ ইলিশ মিয়ানমারের দিকে চলে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে পদ্মা-মেঘনায় বালু তোলা বন্ধের পাশাপাশি ইলিশ রক্ষায় চারটি সুপারিশ করে তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। সেই সঙ্গে নদণ্ডনদী এবং খাল-বিল দখল ও দূষণকারীদের তালিকা চেয়ে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে ৫ অক্টোবর নদণ্ডনদীর অবৈধ দখলকারীদের তালিকা করে তা জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিল কমিশন। সে অনুযায়ী তালিকা করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আর এ সুযোগে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে নদীখেকোরা।

জানা গেছে, চাঁদপুরের অংশে পদ্মা ও মেঘনা নদী গত ৩১ মার্চ তা পরিদর্শন করেন জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী। পরিদর্শন শেষে জেলা নদীরক্ষা কমিটির একটি সভায় তিনি বলেন, ‘অবৈধ বালু উত্তোলনের সময় যখন ৭০০ বাল্কহেড ও ড্রেজার চলমান ছিল, তখন দিনে আনুমানিক ১০ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হয়েছে। গত দুই দশকে দেশের পরিবেশরক্ষার বিষয়ে পদ্মা-মেঘনা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের বিষয়টি বড় সংবাদ।’ পদ্মা-মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলনের দৃশ্যকে নেপোলিয়ান ও নেলসনের নৌযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন ড. মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘ইলিশসহ অন্যান্য মাছের অভয়াশ্রম থেকে বালু উত্তোললন করা যাবে না। জাতীয় এই মাছ আকারে ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাই ইলিশসহ অন্যান্য মাছ এবং পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে।’

সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর চারটি সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ করে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। সেগুলো হলো- মৌজার তথ্য স্পষ্ট না থাকায় বিআইডব্লিউটিএর পদ্মা-মেঘনা নদীর সংশ্লিষ্ট স্থানের হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ ত্রুটিপূর্ণ বিধায় নতুন করে জরিপ করতে হবে। অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ, আর্থসামাজিক ক্ষতির আর্থিক এবং রাজস্ব ক্ষতির মূল্যমান নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরিবেশ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, বিআইডব্লিউটিএ ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর সেই প্রতিবেদন দিতে হবে আগের নির্ধারিত ১৪ দিনের মধ্যেই।

অবৈধ বালু বিক্রির ফলে রাজস্ব ক্ষতির মূল্যমান নির্ধারণ ও অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দেবে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন।

মেঘনা নদীর এ স্থানে অবৈধ বাল্কহেড ও ড্রেজারের বিরুদ্ধে নৌপরিবহন অধিদপ্তর গত তিন মাসে কয়টি মামলা করেছে তা কমিশনকে ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।

সভায় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, দেশের পাঁচটি ইলিশের অভয়াশ্রমের মধ্যে চাঁদপুর অন্যতম। মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে লক্ষ¥ীপুরের চর আলেকজেন্ডার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকা ইলিশের রুট। এর মধ্যে ষাটনল থেকে দক্ষিণে চর ভৈরবী পর্যন্ত চাঁদপুরের ৭০ কিলোমিটার ইলিশের অভয়াশ্রম এলাকায় প্রতি বছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু ওই সময় নদীতে ব্যাপক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। এতে ইলিশের ডিম পাড়া ব্যাহত হয়। খাদ্য সংকট হয়। চলাচল ব্যাহত হয়। এসব কারণে রুট পরিবর্তন করে মিয়ানমারের দিকে চলে যেতে পারে ইলিশ।

জেলা প্রশাসক বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী জনস্বার্থে নির্দিষ্ট মৌজা থেকে ডুবচর কেটে বালু উত্তোলনের অনুমতি আছে। অন্য কোনো জায়গা থেকে বালু উত্তোলন এবং বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ কারণে নদীরক্ষা কমিশনের নির্দেশানুযায়ী ২১ মার্চ অভিযান চালিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, নদীর ভেতরে পানি ঘোলা হলে যেকোনো মাছের জন্যই ক্ষতির। ইলিশ মাছ নদীতে এসে পুষ্টি চায়। কিন্তু বালু খেলে তো আর সেটা হবে না।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তায়েফা আহমেদ বলেন, ইলিশ নদীতে খাবারের জন্য এবং ডিম পাড়ার জন্য আসে। কিন্তু পানি ঘোলা থাকলে সূর্য্যরে আলো গভীরে প্রবেশ করে না। ফলে ফাইটোপ্লাংক্টন তৈরি হয় না এবং জুয়োপ্লাংক্টনও হবে না। ইলিশও খাদ্য পাবে না।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, বালু তুলতে হলে আগে থেকেই ইন্টিগ্রেটেড স্টাডি করতে হয়। ম্যাপ তৈরি করতে হয়। নদীর গভীরতা, প্রশস্ততা এবং দৈর্ঘ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে বালু তুলতে হবে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালক বলেন, চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নৌরুটে নাব্য সমস্যা নেই। তাই ড্রেজিং করার দরকার নেই। কতটুকু বালু উত্তোলন করা হয়েছে এবং কতটুকু রয়েছে, তা নির্ণয়ের জন্য আগে এবং পরে সার্ভে করতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close