সুধীর সাহা

  ২৮ মার্চ, ২০২৪

বিশ্লেষণ

স্মার্ট দেশ গড়তে সরকারের চ্যালেঞ্জ

আওয়ামী লীগ সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনে সমর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ঘোষণা- বাংলাদেশকে তারা স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চান। স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হলে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি এবং স্মার্ট সমাজ গড়তে হবে। এ কাজটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষভাবে স্মার্ট অর্থনীতি এবং স্মার্ট সমাজ নিশ্চিত করা। এর সঙ্গে আছে ভূ-রাজনীতির প্রতিযোগিতা ও অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন। ভূ-রাজনীতির প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে ভারত ও চীন। বাংলাদেশের হৃদয়ে ভারত না চীন কে পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট করতে সক্ষম হচ্ছে- তা-ই আগামী দিনে শেখ হাসিনার ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জের অন্য একটি বড় পক্ষ আমেরিকা। ভোটের আগে তার চ্যালেঞ্জ ছিল; কিন্তু ভোটের পরে এখন তার ওপর আরো বড় চ্যালেঞ্জ ভর করে থাকবে। এবারের নির্বাচনে ভারত যেমন আমেরিকার বিরোধিতা করেছে, তেমন করেছে চীন। ভারত এবং চীন দুটি রাষ্ট্রই চোখ বুজে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছে। তাই নির্বাচন আবহে তারা প্রতিযোগিতা করে, যা দেখার প্রয়োজন, তাই দেখেছে; আর যা দেখার প্রয়োজন নেই, তা দুজনেই দেখেনি। হাসিনাকে নিজ বলয়ে শক্ত করে ধরে রাখতে দুজনেরই চেষ্টার অভাব ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটাও বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার কোনো বিকল্প নেই। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান। নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি এখনো অস্বস্তিতে আছে। সেই অস্বস্তি এবার স্বস্তিতে পরিণত করা যাবে কি না, তা-ও বাংলাদেশের নতুন সরকারকে গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখতে হবে।

স্মার্ট অর্থনীতি এবং স্মার্ট সমাজ নিশ্চিত করা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনীতির অগ্রগতি গড়ে ২ শতাংশের মধ্যে থাকবে। স্পষ্টত বোঝা যায়, অর্থনীতির বৈশ্বিক পরিবেশ এবার বাংলাদেশের অনুকূলে থাকবে না। অভ্যন্তরীণ সক্ষমতাও চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। অন্যতম সমস্যা বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত রপ্তানি সেক্টর এখনো। এখানে প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশেরও কম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত জনশক্তি রপ্তানি। সেখানে প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশেরও কম। সুতরাং অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়ার খুব একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না অদূর ভবিষ্যতে।

বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের সীমা ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে গিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এমন অর্থনীতিকে স্মার্ট হিসেবে টেনে নেওয়া অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বৈকি! কেননা মূল্যস্ফীতি আর আয়বৈষম্য বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত চ্যালেঞ্জের জায়গায় বরাবরই রয়ে গেছে। ঠিক এমন একটি ঝড়ের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে। তিনি সফল কূটনীতিক হলেও অর্থনীতির বেড়াজালে একেবারে নতুন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসে দুই অর্থমন্ত্রীকে একটানা বহু বছর অর্থ মন্ত্রণালয় সামলাতে দেখেছে মানুষ। বিএনপির সাইফুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা কয়েকবার একই দায়িত্বে থাকার কারণে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। তাই নতুন মন্ত্রীর মনের জোর কতটা হবে- আসন্ন ঝড় সামলিয়ে স্মার্ট অর্থনীতি উপহার দিতে তা-ই আমাদের দেখার পালা। আয়বৈষম্য এবং ধর্মান্ধ সমাজ বহুদিন ধরেই চোখ রাঙাচ্ছিল বাংলাদেশকে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর খুব বড় ধরনের সমর্থন নেই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি। সমাজজীবনে এই ধর্মান্ধ শ্রেণি ইতিমধ্যে তাদের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে ভালোভাবেই। ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের পলিসি তা দেখেও না দেখার ভান করেছে। কিন্তু এখন স্মার্ট সমাজ গড়তে হলে সরকারকে শুধু সেদিকে নজরই নয়, বড় ধরনের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।

ভারত-চীন এই দুই পরাশক্তির নিজেদের মধ্যে রেষারেষি আছে সব সময়ের জন্য। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের যেমন আলাদা করে সহযোগিতা আছে, আবার রেষারেষির ঢেউও আছে। মালদ্বীপ নিয়ে নতুন অস্বস্তিতে আছে চীন ও ভারত। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের জন্য একজনকে ছেড়ে দেওয়া মানেই হলো ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখির সমস্যা’। চীন-ভারতের পর আমেরিকা এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে আছে সম্পর্কের জটিল বিষয়টিও। ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ত্রিমুখী সম্পর্ককে আগামী দিনে হাসিনা সরকার কীভাবে ব্যালেন্স করবে- তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চিত্র। অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিভাজিত আন্তর্জাতিক মহলকে মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে নতুন সরকারের সামনে। কেননা এখনো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া স্বস্তিতে নেই।

নির্বাচন রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে টেক্কা দিতে নিজেদের লোকদের ছেড়ে দিয়েছিল স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটযুদ্ধ করার। আপাত কৌশলটি কাজ দিয়েছে নির্বাচনে। কিন্তু নির্বাচনের আগে ও পরে সারা দেশেই আওয়ামী লীগ এবং দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনুসারী কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। আওয়ামী লীগের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরো বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বড় ধরনের সংঘাতের দিকে মোড় নিতে পারে। বিরোধী দলের সঙ্গেও সরকারি দলের সম্পর্ক ভালো নেই। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে চাইলে সরকারকে বিরোধী দলের রাজনীতিকে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসার ভূমিকা নিতে হবে। এতে একদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আবহাওয়ার উন্নতি হবে এবং আন্তর্জাতিক মহলকেও যুক্তিসংগত স্বস্তির বার্তা দিতে পারবে। কেননা সরকারের বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ, বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে এখনো অস্বস্তি কাটেনি।

ঋণের বোঝা আছে বাংলাদেশের মাথায়। নতুন করে ঋণ পাওয়ার জায়গাও বাংলাদেশের সামনে খুব বেশি নেই। এ মুহূর্তে সবচেয়ে লাভজনক ছিল যেটি, সেই বিদেশি বিনিয়োগও বাংলাদেশ টানতে পারেনি। দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগই বাংলাদেশের জন্য আশার সঞ্চার করতে পারছে না। অন্যদিকে কোভিড সময়ে প্রায় শুয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙা করতে গিয়ে এবং জনদরদি সরকারব্যবস্থার ধারণা দিতে সরকার ব্যাপক খরচ করেছে বিভিন্ন কল্যাণ প্রকল্পে। এসবের কারণে অর্থনীতি এমনিতেই চ্যালেঞ্জের মুখে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ করার সম্ভাবনা ছিল যাদের ওপর, তাদের অনেককেই টেনে আনা হয়েছে রাজনীতিতে। তারা রাজনীতি করতে গিয়ে এবং এমপি-মন্ত্রী হতে গিয়ে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং নতুন বিনিয়োগের দিকে মন না দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

সব মিলিয়ে নতুন সরকারের সামনে বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জই অপেক্ষা করছে। এবার অপেক্ষাকৃত একটি ভালো মন্ত্রিসভা উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে হয়তো একটু স্বস্তি আছে। কিন্তু সেই স্বস্তির থেকেও চ্যালেঞ্জের অস্বস্তি আরো শক্তিশালী হতে পারে। হাসিনা সরকারের চতুর্থ জয় যত সহজে সম্ভব হয়েছে, সামনের সরকার পরিচালনা করে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে দেশকে এগিয়ে নেওয়া ততটাই কঠিন হতে পারে।

লেখক : কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close