ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

  ১৭ মার্চ, ২০২৪

শ্রদ্ধাঞ্জলি

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস

গোপালগঞ্জের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছায়া সুনিবিড় ছোট্ট একটি গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। গ্রামটির কোল বেয়ে বয়ে যাওয়া মধুমতী নদী। এই গ্রামেই ১৯২০-এর ১৭ মার্চ জন্মেছিল এক শিশু। ছোটবেলায় বাবা-মা আদর করে তাকে ডাকতেন খোকা বলে। ছোট্ট গ্রামের এই ছোট্ট খোকা এক দিন হলেন বাঙালির বড় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য নামটি রেখেছিলেন তার মাতামহ। আর শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু; এবং সব শেষে জাতির জনক- স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি।

কথায় বলে উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়। অথবা সকাল বলে দেয় সারা দিনের কথা। পেছন ফিরে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না শিশু খোকা কেন ও কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। শিশুটির বেড়ে ওঠা জীবনের অনেক ঘটনা ছিল, যা বলে দিয়েছিল এই খোকা আর দশটি সাধারণ খোকার মতো নয়; এই খোকা ব্যতিক্রমী খোকা ছিল। কালক্রমে এই ব্যতিক্রমী খোকা হয়েছিল বাঙালির ব্যতিক্রমী নেতা।

কিশোর খোকা জীবন শুরুর দিকে একটি ঘটনা। ১৯৩৮ সাল। খোকা তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। সঙ্গে ছিলেন শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল পরিদর্শন শেষে তারা ফিরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের পথ আটকে দাঁড়ালেন এই কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান। সবাই বিস্মিত, কিছুটা বিব্রতও। প্রধান শিক্ষক হতভম্ব ও ক্রুদ্ধ। কিন্তু কেন এই দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের পথ আটকানো? কোনো দ্বিধা বা জড়তা ছাড়াই এই কিশোর দাবি করলেন, স্কুল ছাত্রাবাসের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে; তা মেরামতের ব্যবস্থা না করে মন্ত্রী দুজন যেতে পারবেন না। কিশোরের সাহস আর দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ শেরে বাংলা জানতে চাইলেন, ছাত্রাবাস মেরামত করতে কত টাকা লাগবে। হিসাবটা আগেই করা ছিল বলেই ভবিষ্যতের বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন : বারো শ টাকা। টাকা তাৎক্ষণিক বরাদ্দ হলো, ছাত্রাবাসটিরও মেরামত হলো। একজন কিশোরের সাহস আর দৃঢ়তার জন্য তা সম্ভব হয়েছিল, স্কুল প্রশাসনের কোনো ভূমিকার জন্য নয়। নেতৃত্ব হঠাৎ গজিয়ে ওঠে না; নেতৃত্ব জীবনের শুরু থেকে সাধনার ফসল।

এর কিছুদিন পর ঘটল আরো একটি ঘটনা। সেবার টুঙ্গিপাড়ায় ফসল ভালো হয়নি। দরিদ্র কৃষকের ঘরে হাহাকার। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কিশোর শেখ মুজিব এমন কজন কৃষককে বাড়ি ডেকে নিয়ে এলেন। তিনি ধানভরতি গোলা থেকে তাদের প্রত্যেককে ধান দিলেন।

তিনি তা করেছিলেন বাবার অনুপস্থিতিতে এবং মাকে না জানিয়ে। পরে বাবার বকা খেয়ে তার দৃঢ় উত্তর ছিল : গরিবেরও পেট আছে, তাদেরও খিদে আছে। আমাদের অনেক আছে, তা থেকে কিছু দিয়েছি মাত্র। সেদিন ছেলের মানবিকতায় মুগ্ধ বাবা আর বকেননি। আজীবন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাওয়া বঙ্গবন্ধুর জীবন শুরু হয়েছিল এভাবে।

শিশু-কিশোর খোকা কালক্রমে যখন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি হলেন তখনো শিশু-কিশোরদের ভোলেননি। শিশু অন্ত মানুষ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন তাই সংগত কারণে জাতীয় শিশু দিবসও। বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোরদের বড় ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শৈশবে বা কৈশোরে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, বাঁধনহারা আনন্দে দিন কাটিয়েছেন। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা যাতে হেসেখেলে মুক্তচিন্তায় মুক্ত মনে বেড়ে ওঠার সুযোগ ও পরিবেশ পায় সে কথা তিনি ভাবতেন।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ। কিন্তু তিনি সেদিন আনুষ্ঠানিক জন্মদিন পালন না করে শিশুদের নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটাতেন। ৭১-এর ১৭ মার্চ তিনি একজন বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিনই কী। আর মৃত্যুদিনই বা কী?’ অবশ্য আমরা তার জন্মণ্ডমৃত্যুদিন পালন করি বিবেকী দায়বদ্ধতা থেকে।

বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল ছিল তার নয়নমণি ও বাংলাদেশের সব শিশুদের প্রতীক। এ প্রসঙ্গে জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়ার ভাষ্য লক্ষণীয় : ‘রাসেল ছিল বঙ্গবন্ধুর কলিজার টুকরা। তিনি রাসেলকে এ দেশের সমস্ত শিশুর মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি শিশুই তার পিতা-মাতার কাছে বড় আদরের। এখানে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। আমাদের নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটাকে ভালো করে গড়তে হলে এই শিশুদের সঠিকভাবে গড়তে হবে। ওদের তাজা রক্তে দেশপ্রেম ঢোকাতে হবে। ওদের ভালোমতো গড়তে পারলেই আমি সার্থক।’ কথাগুলো বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি তখনকার, ভাষ্য ড. ওয়াজেদ মিয়ার।

রোকনুজ্জামান দাদাভাই সারাজীবন শিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, শিশুদের সব অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যেত। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুর মতো সরল একজন, তার হাসিও ছিল শিশুর মতো; আর তাই সারা পৃথিবীর ভালোবাসা তার জন্য। রোকনুজ্জামান দাদাভাই আরো জানান ১৯৬৩-এর শীতকালে ঢাকা প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে আয়োজিত দশ দিনব্যাপী এক শিশুমেলার কথা। এই মেলায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি) বলেছিলেন : ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’ অন্যদিকে, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-বৃদ্ধ সবার কাছে তিনি ছিলেন মুজিব ভাই। এই সম্বোধন তিনি পছন্দ করতেন। এর ফলে বয়সের ব্যবধান ঘুচে যেত; তিনি হয়ে উঠতেন সবার একান্ত আপন, যেন আত্মার আত্মীয়। এসব গুণের জন্য তিনি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু; এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনক- বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।

১৯৭২-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। সে সময়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য গণভবন ‘সুগন্ধা’য় যান এবং বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটুখানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।’ এই মহৎ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সঙ্গে আসা দাদাভাই, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন ও লুৎফুল হায়দার চৌধুরীকে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

১৯৭২-এর এক সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বেরিয়েছেন, যেমনটি রোজ বের হন। সঙ্গে বড় ছেলে শেখ কামাল। তিনি হঠাৎ দেখলেন একটি ছোট ছেলে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কাছে ডাকার পর ছেলেটি জানায়, তার পা ব্যথা করছে বলে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু নিজে ছেলেটির জুতা খুলে দেখেন যে, জুতার মধ্যে একটি পেরেকের সুচালো মাথা বেরিয়ে আছে, যার খোঁচায় ছেলেটির পা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখনই চিকিৎসার জন্য তার দেহরক্ষী পুলিশকে নির্দেশ দিলেন, তার হাতে কিছু টাকাও দিলেন। আর পরম মমতায় ছেলেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। একবার বঙ্গবন্ধু ঢাকা শহরে গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিলেন (সম্ভবত বাংলাদেশ হওয়ার আগে)। গাড়ির কাচ নামানো ছিল। চলতে চলতে ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে গাড়িটি থেমে যায়। হঠাৎ করে ১০-১২ বছরের এক টোকাই গাড়ির কাছে এসে বলে, ‘অ্যাই শেখ সাহেব কেমন আছেন?’ বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, ‘ভালো আছি’; এবং ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। তিনি সব বয়সের মানুষের পরিচিত আপনজন ছিলেন- যথার্থ বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৪-এ গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে তখনকার শিশুপার্কে আয়োজিত শিশুমেলা শেষে সমবেত শিশুরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায়। শিশুরা চাইলেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারত। সবার হাতে মিষ্টির প্যাকেট তুলে দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু একে একে সব শিশুর নাম শুনলেন। একটি শিশু তার নাম মুজিবুর রহমান বলায় বঙ্গবন্ধু আদর করে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘পেয়েছি, আমার মিতাকে পেয়েছি।’

বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট চারটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এক. শিশুকল্যাণের জন্য মায়েদের সম্পৃক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন মা ও শিশুকল্যাণ অধিদপ্তর। দুই. শিশুর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু একাডেমি। এ দুটো প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত ভাবনা-পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর সব সময়ই ছিল। তিন. শিশুর শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩-এ ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশের সে সময়ের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্তটি ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী। চার. ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন জারি করা হয়। এ আইন শিশু অধিকারের রক্ষাকবচ। ১৯২০-এর ১৭ মার্চ যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল সে আজীবন ছিল শিশুর মতো সরল। তার এ সারল্যকে কাজে লাগিয়েছিল ঘাতকচক্র।

লেখক : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close