অলোক আচার্য

  ১৩ মার্চ, ২০২৪

আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ

উত্তেজনা বাড়াবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি

ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের টানাপড়েনের অন্যতম ইস্যু বা ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার অন্যতম কারণ হলো ইরানের পরমাণু কার্যক্রম সমৃদ্ধকরণ। যদিও ইরানের পক্ষ থেকে বরাবরই পরমাণু অস্ত্র তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটা নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বল গতি-প্রকৃতি এবং সেই সঙ্গে জ্বালানি অস্থিরতা ও ইসরায়েলের গাজায় আগ্রাসনের কারণে মনোযোগ সেদিকে থাকায় এত দিন এ নিয়ে কোলাহল ছিল না বললেই চলে। তবে সম্প্রতি আবারও ইরানের পরমাণু ইস্যুটি সামনে এসেছে। এটি এমন একটি সময় যখন মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত হয়ে আছে। পরিস্থিতি যেকোনো খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে। সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম সমৃদ্ধকরণের অগ্রগতির খবর নিশ্চয়ই স্বস্তিদায়ক নয়। অন্তত পশ্চিমা বিশ্বের জন্য তো বটেই। তা ছাড়া পরমাণু অস্ত্রের মতো ভয়াবহ ইস্যুটিই বস্তুতপক্ষে অস্বস্তিদায়ক।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রসি ইরানের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমনকি তিনি ইরান যেতে চাইলেও তেহরান তার এ সফরের অনুমতি দিচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জোটের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের উদ্দেশে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি রাফায়েল গ্রসি বলেন, ‘গত বছর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা কখনো কম ছিল, কখনো বেশি ছিল। তবে দেশটি এখন উচ্চহারে সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত রেখেছে। ইরানে প্রতি মাসে ৭ কেজি ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতার মাত্রা স্পর্শ করছে। এই ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতার মাত্রা আসলে কী? এটি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব এবং আইএইএর মত হলো, ইউরেনিয়াম ধাতুকে ৬০ শতাংশ মাত্রায় বিশুদ্ধতার অর্থ হচ্ছে, অস্ত্র উৎপাদনের গ্রেডকে স্পর্শ করা। এখানে উল্লেখ্য, ইরানের আগে কোনো দেশ বেসামরিক উদ্দেশ্যে এত ব্যাপক মাত্রায় ইউরেনিয়াম পরিশুদ্ধ করেনি। সংস্থাটি সম্প্রতি বলেছে, তেহরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করছে। আইএইএর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইরান ইউরেনিয়াম মজুদ করেছে ৫ হাজার ৫২৫ দশমিক ৫ কেজি। গত বছর নভেম্বর মাসে দেশটির কাছে মজুদ থাকা ইউরেনিয়ামের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৮ কেজির সামান্য বেশি। অর্থাৎ কয়েক মাসের মধ্যে ব্যাপক হারে ইউরেনিয়াম মজুদ করেছে তারা। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ২০১৫ সালে সই হওয়া চুক্তি, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ২০১৮ সালে বাতিল করে সেই চুক্তিতে থাকা মাত্রার তুলনায় ২৭ গুণ বেশি ইউরেনিয়াম মজুদ রয়েছে তেহরানের কাছে।

ইরানের পারমাণবিক ইস্যুটির সমাধান আসলে একটি দীর্ঘায়িত ঝুলন্ত ইস্যু, যা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় ঝিমিয়ে পড়েছে। এটি আবার জীবিত হবে কি না তা নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায় না অন্তত এই পরিস্থিতিতে। যখন দেশগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার দীর্ঘ পরিকল্পনায় ব্যস্ত রয়েছে। ইরানের পরমাণু চুক্তির লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স এবং তাদের সঙ্গে জার্মানি মিলে (পি৫+) ২০১৫ সালে তেহরানের সঙ্গে ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)’ শীর্ষক চুক্তি করে। ওই চুক্তির আলোকে মাত্র ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করত ইরান। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে ওই চুক্তি থেকে সরিয়ে নেয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন চুক্তিতে ফেরার কথা বললেও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এ নিয়ে দর-কষাকষির কারণে এখনো কোনো চুক্তি হয়নি। ওই সময়ের পর থেকে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়াতে থাকে। ইরান আইএইএর প্রতিনিধিদের চুল্লি পরিদর্শন করতে দিচ্ছে না। ২০২১ সালে শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। অর্থাৎ চুক্তিটি আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি। আপাতত কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। ১৯৭০-এর দশকে রাজতান্ত্রিক শাসনে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রথম পরমাণু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর এই প্রকল্প থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ালেও ইরান প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখে। ২০১৮ সালে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে পরমাণু চুক্তিতে ফেরার ঘোষণা দেন।

মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে নতুন সমীকরণ হচ্ছে। সেই সঙ্গে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিও উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। যদিও ইরান বলেছে এ কর্মসূচি পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য নয়। কিন্তু তা বিশ্বাস জোগাতে সক্ষম হয়নি। নতুন করে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র আবিষ্কৃত হলেও এখনো মানুষের মনে যে অস্ত্র ভীতির সঞ্চার করে তা হলো পরমাণু অস্ত্র। বিভিন্ন দেশের উত্তেজনায় পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার না হলেও মাঝেমধ্যেই তা হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। এই চুক্তির সফলতা নিয়ে আগ্রহী সারা বিশ্ব। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর পূর্ব থেকেই পরমাণু এ চুক্তির বিরোধিতা করত এবং পূর্বসুরি ওবামা আমলে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিকে ‘ক্ষয়িষ্ণু ও পচনশীল’ আখ্যা দিয়ে ২০১৮ সালের মে মাসে তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তেহরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি পুনরায় গতিশীল করে। পরমাণু সমঝোতায় ইরানকে সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোগ্রাম-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ইরান ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত ওই সমঝোতা মেনে চলেছিল। তেহরান বারবার বলে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে ফিরলে এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েলে ইরান তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ এখানে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ইরানের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার বিষয়, যা এর আগেও সামনে এসেছে। পরমাণু চুক্তিতে ফেরা গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, পৃথিবী আর পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা দেখতে চায় না। জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মোট ৫ হাজার ৯৭৭টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে রাশিয়ার, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ৫৫০টি বেশি। বিশ্বে মোট পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের ৯০ শতাংশেরও বেশি এই দুই দেশের কাছে আছে। কোনোভাবে এর প্রয়োগ শুরু হলে পৃথিবীর অস্তিত্ব যে থাকবে না সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। পৃথিবীর স্বার্থেই এই চুক্তিটির আবার জীবন ফেরাতে হবে। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, আগামী নির্বাচনে যদি আবারও ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন তাহলে তিনি তার আগের অবস্থান বদলাতে পারেন- এমন আশা করা যায় না। অতএব, ইস্যুটি একেবারে মরে যাওয়ার আগেই পুনরায় জীবন দেওয়া প্রয়োজন। তবে কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিন এবং প্রায় দুঃসাধ্য, অন্তত এই মুহূর্তে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close