মোছা. শাহনাজ পারভীন

  ১১ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যথার্থই বলেছিলেন, ‘আমরা পুরুষের ন্যায় সাম্যক সুবিধা না পাইয়া পশ্চাতে পড়িয়া আছি।’ বাংলাদেশের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল যার বাস্তব উদাহরণ। ২০২৩ সালে এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যেখানে ছাত্রীদের পাসের হার ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ছাত্রদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। একই চিত্র পরিলক্ষিত হয় ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায়, যেখানে গড় পাসের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ছেলেদের ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং মেয়েদের ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। শুধু পাসের ক্ষেত্রেই নয় জিপিএপ্রাপ্তিতেও ২০২২ ও ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে মেয়েরা এগিয়ে। অভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয় ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রেও। ২০২২ সালের ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছেলে পরীক্ষার্থী ছিল ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৩ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন। পাসকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল, ছেলে ৮ লাখ ৭০ হাজার ৪৬ এবং মেয়ে ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৩ জন। অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় ক্ষেত্রেই মোট মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও তাদের পাসের হার, ছেলেশিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা ছেলেশিক্ষার্থীর তুলনায় বেশি থাকলেও উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হয় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য মতে, উচ্চশিক্ষায় মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ৫১ দশমিক ৮৯ শতাংশ ।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা কম থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ ডিপার্টমেন্টে সিজিপিএপ্রাপ্তিতে ছেলেশিক্ষার্থীর তুলনায় মেয়েশিক্ষার্থীরা এগিয়ে। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু

বিভাগ যেমন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট,

নৃত্যকলা বিভাগ, রসায়ন বিভাগসহ অন্য বিভাগগুলোতে সিজিপিএপ্রাপ্তিতে মেয়েরা এগিয়ে।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ অংশ বাস করে গ্রামে। উচ্চশিক্ষায় শহুরে মেয়েদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো হলেও গ্রামে মেয়েদের অবস্থা অনেকটা নাজুক এখনো। গ্রামে এখনো মেয়েদের শুধু পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতা অধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে সুযোগের অভাবে গ্রামের মেয়েরা উচ্চশিক্ষা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের বাবা-মা ও অন্যান্য সদস্য ছেলেদের শিক্ষাগ্রহণের কথা চিন্তা করলেও মেয়েদের বেলায় শুধু বয়স ১৪-১৫ বছর হওয়ার অপেক্ষা করে এবং এ সময় পর্যন্ত স্কুলে পাঠায়। ১৪-১৫ বছরে প্রবেশ করলে অনেক বাবা-মা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। তবে বর্তমানে শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ রোধে প্রশাসনের সতর্ক দৃষ্টির ফলে অনেক বাবা-মা মেয়েদের এসএসসি এবং এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহী করলেও মিলছে না উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ।

গ্রামীণ মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো বাবা-মা মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে অধিক খরচ মেটাতে না চাওয়ার প্রবণতা, সরকারের পক্ষ থেকে বৃত্তি বা আর্থিক ব্যবস্থা না থাক, পাশাপাশি অনেক পরিবারে বাবা-মা মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন হলেও সমাজের লাঞ্ছনা-গঞ্জনার ভয়ে বাবা-মা মেয়েদের আবাসিক হোস্টেলে রেখে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেয় না। গ্রামীণ সমাজের মানুষ ধারণা করে মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে আবাসিক হোস্টেলে থাকলে খারাপ হয়ে যাবে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক বাবা-মা সমাজের ভয়ে এবং পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য মেয়েদের আবাসিক হোস্টেলে রেখে শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করে না। অর্থাৎ মেয়েরা সুযোগের অভাবে নিজেদের একনিষ্ঠ মনোযোগ দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মেধার সঠিক ব্যবহার করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে দেশের সরকারকে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে পর্যাপ্ত বৃত্তি-ভাতা ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থার মাধ্যমে। গ্রামীণ সমাজে উচ্চশিক্ষায় নারী গুরুত্ব বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। তাহলে দেখা যাবে শুধু এসএসসি বা এইচএসসির ফলাফল নয় সুযোগ পেলে বাংলাদেশের মেয়েরাও এক দিন ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা কিংবা মাদাম কুরির মতো উচ্চ শিখরে পৌঁছাবে। তার জন্য দেশ সমাজের এবং সমাজকে নিজ নিজ অবস্থা থেকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সমাজে নারীরা যেসব প্রতিবন্ধকতার শিকার হয় যেমন : সরকারের পক্ষ থেকে প্রর্যাপ্ত বৃত্তি-ভাতার ব্যবস্থা, আবাসন সংকট, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধতা, বাবা-মা মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অসচেতনতা, সামাজিক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ইত্যাদি রোধ করে গণসচেতনতা বৃদ্ধি

করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close