নাজনীন বেগম

  ১১ মার্চ, ২০২৪

বিশ্লেষণ

স্মৃতিবিজড়িত সংগ্রামী মাস

স্বাধীনতার মাসটি যখন তার বহুল প্রত্যাশিত আবেদন নিয়ে সারা জাতিকে মাতোয়ারা করে দেয়, সেখানে বর্তমান বাংলাদেশও তার সার্বিক মাহাত্ম্য নিয়ে হাজির হয়। ২০২৪ সালের মার্চ মাস পার করার অনন্যক্ষণকে সামনে আনতে গিয়ে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, পিচ্ছিল ৭১ সামনে এসে তার অনন্য গৌরবান্বিত ঐতিহাসিক পটভূমিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

১৯৭১ সালের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক মাস মার্চ। আর ২০২৪ সালের মার্চে দেখতে পাচ্ছি অন্যরকম উন্নত ও আধুনিক বাংলাদেশ। অর্ধশত বছর পার করে বর্তমানে লড়াকু মার্চের মহিমা বর্ণনা সহজ হলেও ৭১-এর রক্তপ্লাবিত মার্চ অনুভবে চেতনায় জেগে আছে। তবে বাস্তবের সেই সংগ্রামী দুঃসহ ক্ষণ আজ সত্যিই এক কঠিন বাতাবরণ। তবে আমরা ২০২৪ সাল অতিক্রম করার সূচনাপর্বে যে সোনার বাংলা আর আধুনিক প্রযুক্তির দেশকে পেয়েছি, তা অনন্য এক অভিযাত্রা তো বটেই।

সেই অদম্য মার্চের সর্বাংশ জুড়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭১-এর পুরো মার্চ ছিল এক সংগ্রামী জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধুর অনন্য জীবনযুদ্ধের অবিস্মরণীয় কালপর্ব। আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল তারই এক ঐতিহাসিক পটভূমি ও দায়বদ্ধতা। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন এক অদম্য ভাষাসৈনিক। যিনি কি না ভাষা আন্দোলনের জন্য আটক হওয়া প্রথম বাঙালি যোদ্ধা। সেই শুরু লড়াকু বাঙালির স্বাজাত্যবোধে দুর্বিনীত যাত্রাপথের সারথির ভূমিকায় নিজেদের প্রমাণ করা। আর তেমন দুর্দান্ত অভিগমনে সার্বক্ষণিক কর্মতৎপরতায় বঙ্গবন্ধুর চিরস্থায়ী শৌর্য আজও বাংলা ও বাঙালির ঐতিহাসিক সম্ভার। সংগত কারণে স্বাধীনতার মাসটি যখন তার বহুল প্রত্যাশিত আবেদন নিয়ে সারা জাতিকে মাতোয়ারা করে দেয়, সেখানে বর্তমান বাংলাদেশও তার সার্বিক মাহাত্ম্য নিয়ে হাজির হয়। ২০২৪ সালের মার্চ মাস পার করার অনন্যক্ষণকে সামনে আনতে গিয়ে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, পিচ্ছিল ৭১ সামনে এসে তার অনন্য গৌরবান্বিত ঐতিহাসিক পটভূমিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

স্বাধীনতার মাসটির মহিমার যেন শেষ পরিশেষ নেই। স্মরণে বরণে সিক্ত করা ছাড়াও রক্তস্নাত পঙ্কিল যাত্রাপথও বিক্ষুব্ধ এক বাতাবরণ। আনন্দ, আবেগ আর দুঃসহ রক্তস্নাত স্মৃতিবিজড়িত মাসটি জাতির জন্য এক কালজয়ী আখ্যান। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে শুরু করে ১৭ মার্চের জাতির জনকের শুভ জন্মদিন এক মিলিত সৌরভ জাতিকে নির্দিষ্ট পথরেখা নির্দেশিত করে দেয়। তা ছাড়া ২৫ মার্চের রক্তাক্ত কালরাতে বিশ্ব ইতিহাসের নিকৃষ্টতম অধ্যায়টি আজও শিহরণ জাগায়। আবার ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা জাতিকে যে রূপরেখায় এগিয়ে দেয়, তার দাম কিছুতেই হয় না। ৭১-এর মার্চ আবেগ আর উৎসবের স্রোতে যেমন বাঙালি জাতিকে ভাসিয়ে দেয়, একইভাবে রক্তবিধৌত অনধিগম্য যাত্রাপথ মোকাবিলা ও দেশকে এক অরাজক অবস্থার শিকার করে। তখন চলে ৯ মাসের অদম্য অস্থিরতা, লাখ লাখ শহীদানের আত্মাহুতি। কয়েক লাখ জায়া, জননী, ভগিনীর সম্ভ্রমহানিতার উন্মত্ত আস্ফালন।

সুখ-দুঃখের এমন অঙ্গাঙ্গি পালাক্রম বিশ্ব ইতিহাসে আর কখনো ঘটেছে কি না জানা নেই। একটি স্বাধীন মাতৃভূমির সম্ভ্রম রক্ষার্থে আপামর বাঙালির যে জীবন-মরণ যন্ত্রণা তা গৌরবোজ্জ্বল আখ্যান হলেও বেদনাবিধুর যাতনার পঙ্কিলতা, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ইহুদি নিধন রক্তক্ষয়ী অভিযানকেও স্থান করে দেয়। ২৫ মার্চের জঘন্য বাঙালি নিধন, সভ্যতা সূর্যকে আড়াল করে দেওয়ার দুঃসহ মর্মান্তিক অধ্যায়। সেই রাতে ঢাকার রাজপথে যে রক্তের বন্যাপ্লাবিত হয় তা ঐতিহাসিক দুর্যোগের এক মহাকালরাত, যা সহজে ভোলা যায় না। আবার নতুন সূর্যোদীপ্ত আলোও আবহমান বাংলা এবং বাঙালিকে নবকিরণে উদ্ভাসিত করে। ২৬ মার্চে জাতির স্থপতির স্বাধীনতার ঘোষণা। পরে তাকে আটক করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। শুরুটা সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকেই, যাকে ইউনেসকো বিশ্ব ইতিহাসের ঐতিহ্যিক দলিল হিসেবে সম্মানিত করে।

শত্রুপরিবেষ্টিত দাবানলে উপস্থিত বাগ্মিতায় যে অনলবর্ষী বাণী জাতির সামনে হাজির করেন, বঙ্গবন্ধু তেমন সম্মোহনের রেশ তো আজও কাটার নয়। বাস্তবের কঠিন মাটিতে পা রেখে স্বপ্নের চূড়ায় উঠে যাওয়া এক জননায়কের অবিস্মরণীয় দ্যুতি, যা আজও বাংলা ও বাঙালিকে আলোকের অবারিত ধারায় বইয়ে দিচ্ছে। উদ্বেলিত মার্চ তাই বাংলাদেশের এক অনন্য মাইলফলক, যা জন্মণ্ডজন্মান্তরের সাধনযজ্ঞই নয়, বরং চিরস্থায়ী বৈভবের অভাবনীয় সম্ভার। দেশ আজ যখন অবারিত উদ্যোমে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে, তখন মহিমান্বিত, ঐশ্বর্যসিক্ত মার্চ তার শক্তিময়তায় জাতির প্রাণিত সম্পদকেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। সেই অগ্নিঝরা লড়াকু মার্চ সর্ববিধ আবেদন আর সমর্পণে জাতিকে বটবৃক্ষের মতো ছায়ায় নিত্যনতুন গৌরবের অংশীদার করতে পেছন ফিরে দেখছে না পর্যন্ত। আজ আমরা যে আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশকে নতুন মাত্রায় অবলোকন করছি স্বাধীনতার মাসটি তারই অনন্য মাইলফলক।

৭ মার্চের ভাষণ শুধু যে নির্মম শৃঙ্খলের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ তা কিন্তু নয়, আপামর বাঙালিকে লড়াকু উদ্যোমে জাগিয়ে তোলাও ছিল ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা। জাতির জনক তেমন বার্তাকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে নিয়ে যেতে যে সংগ্রামী অভিগমনকে আলিঙ্গন করেন তাও ঐতিহাসিক পারদর্শিতা বলাই যায়। কিছু ব্যক্তিত্বসমৃদ্ধ ইতিহাসের স্রোতে তৈরি হন। আবার কেউ কেউ নিজেই ইতিহাসের নায়ক আর ধারক-বাহক হন। বঙ্গবন্ধু শেষোক্ত নজিরের অনন্য স্থপতি। যিনি শুধু স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি, পূরণের অভিগমনেও নিরন্তর যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার উপস্থিত, সাবলীল কথা বলার সক্ষমতা ছিল আশৈশব। সেই সঙ্গে ছিল দেশপ্রেম আর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সচেতনতা। সুউচ্চ, ভরাট কণ্ঠস্বর বরাবরই বঙ্গবন্ধুকে শানিত আর প্রাণিতও করে যেত। সময়ে তা ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতারও অনুষঙ্গ হয়ে যায়। ভরা বসন্তের ফাল্গুনের শেষ বিকেলে অস্তগামী সূর্যের পাদদেশে উন্নত মম শিরে দাঁড়িয়ে যে বাণী ঝঙ্কৃৃত করলেন তার মহিমা আজ অবধি বাঙালির পরম শক্তি।

বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো যে নান্দনিক শব্দ হুঙ্কারে জাতিকে একতাবদ্ধ করলেন, তার প্রভাবে দখলদার বাহিনীর ভিত পর্যন্ত নড়ে উঠল। ভরা জনস্রোতে তেমন বাগ্মিতা আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন আছড়ে পড়ে। শৈল্পিক দ্যোতনার মহাকাব্যিক উপখ্যান তো বটেই। পরবর্তী যাত্রাপথ একতাবদ্ধ বীর বাঙালির সম্মুখ সমরকে আলিঙ্গন করা। তাই গৌরবান্বিত এই মার্চ মাসের শুভাগমন দেশ ও মানুষের জন্য অনন্য ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ। শুধু কি তাই? নিত্যনতুন বাতাবরণে উন্নয়নযজ্ঞের মহাসম্মেলনে সামনে চলার পথ অবারিত করাই স্বাধীনতার মাসটির চিরস্থায়ী বন্দনা আর অকুতোভয় অভিযাত্রার পরম নির্মাল্য। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে নানামাত্রিক ঘটনার পালাক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি যেন বিনি সুতার মালার মতো গাঁথা।

যুগ যুগান্তরের পরম ঐতিহাসিক বরমাল্য, চির উন্নত মার্চ ভয়াল, কালো অন্ধকারে নিপতিত হতেও যেন সময় নেয়নি। স্বাধীনতার রক্তিম আভাকে অমানিশার ঘোর অন্ধকারে ঢেকে দেওয়াও মার্চ মাসের নিদারুণ দাবদাহ। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা আর পাকিস্তানি সমরনায়কদের হাতে বন্দি হয়ে বঙ্গবন্ধুর কারাগারে চলে যাওয়াও ইতিহাসের নির্মম ও মর্মস্পর্শী যাতনা। শুধু কি তাই? পাকিস্তানে তিনি কীভাবে ছিলেন তা জানার সুযোগও হয়নি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। ৯ মাসের রক্তবন্যায় বাংলার মাটি যখন লাল স্রোতে ভাসমান, তেমন ঘোরতর অভিশাপে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফেব্রুয়ারির ভাষার মাস থেকে স্বাধীনতার মন্ত্রে মহিমান্বিত মার্চ মাস ঐতিহাসিক মেলবন্ধনের অনন্য প্রেক্ষাপট। সমৃদ্ধ সংগ্রামী পটভূমির যে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রাপথ তার শুরুটাই ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের যে ঐতিহাসিক ভাষণ সেটাই স্বাধীনতার বীজ বপনের সমৃদ্ধ কথামালার অনন্য শৌর্য। মার্চ মাসের তাৎপর্য আর রক্তিম আভাকে চলার পথের অদম্য যাত্রায় সব বাঙালি এক ও অভিন্নভাবে সাড়ম্বরে, মহা-প্রস্তুতিতে সামনের দিকে তাকানো ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলাও ছিল না। আত্মপরিচয় আর অস্তিত্ব সংকট রক্ষায় বীর বাঙালিকে আপসহীন লড়াইয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়।

সামরিক শাসনের দুঃশাসনে জাতি যখন বিপন্ন, বিভ্রান্ত তেমন অশান্ত পরিবেশে স্বাধীনতার অদম্য লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে বাঙালিদের থমকেও দাঁড়াতে হয়নি। অপশাসনের আধিপত্যের বিপরীতে দুঃসাহসিক শরণাপন্ন যুদ্ধ অপরিহার্য বিবেচনায় আত্মোৎসর্গতার যে সাবলীল পরিক্রমা তা স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকে আজও নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। চলছে ২০২৪ সালের মহিমান্বিত মার্চের অনন্য শুভক্ষণ। বাঙালি জাতি ৫৩তম স্বাধীনতা দিবসের দ্বারপ্রান্তে। মাঝখানে কত চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে রক্তাক্ত যাত্রাপথে। স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও মুক্তিসংগ্রামের বীরনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত, স্বাধীনবেশে বাংলাদেশে পা রাখলেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের পালাক্রমে স্বদেশীয় ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়া এক বেদনাবিধূর করুণ আখ্যান। পাকিস্তানি নির্মম হানাদার সামরিক জান্তা যাকে সামান্যতম আঁচ লাগাতে সাহস করেনি, সেই বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয় স্বদেশীয় দোসরদের কোপানলে। দুর্বৃত্তরা হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং এমন জঘন্যতম নারকীয় কাণ্ডের বিচার হতে না পারার আইনও জারি করে।

তেমন অপশাসন আর জঘন্য আইন বাতিলে দেশ ও জাতিকে যুগেরও অধিক সময় অপেক্ষমাণ থাকতে হয়। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পর্যায়ও নিষ্কণ্টক আর নির্বিঘ্ন ছিল না। পরবর্তী ইতিহাস আর এক লড়াকু অভিযাত্রার বিরতিহীন অদম্য রাস্তা।

লেখক : সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close