সুমন চৌধুরী

  ১০ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

চাষি বাঁচলে, বাঁচব আমরা

মানুষের মৌলিক চাহিদা বলতে খাদ্য (অন্ন), বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাকে বোঝায়, কিন্তু প্রধানত অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান এই তিনটি। তবে, প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য। আর এই খাদ্যের চাহিদা পূরণ করেন চাষি। দেশের সব ধরনের ফসল উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের নাম কৃষক। সব পেশা গুরুত্বপূর্ণ-সম্মানের এটা আদৌ অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু সব পেশার কাজগুলো দেশের সব মানুষের জন্য সমান জরুরি এটি ঠিক নয়। তাই পেশাকে যদি দুটি শব্দে বিভক্ত করি তাহলে সব ধরনের পেশা হবে গুরুত্বপূর্ণ এবং চাষি নামক পেশা হবে জরুরি।

হ্যাঁ, একজন মানুষের ৬টি মৌলিক চাহিদা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সব চাহিদার আগে খাদ্য নামক চাহিদা প্রথম ও প্রধান নিঃসন্দেহে বলতেই পারি। আপনি গভীরভাবে চিন্তা করেন আপনার বাসস্থান আছে কিন্তু খাদ্য নেই, সে সময় বাসস্থানের কোনো গুরুত্বও থাকবে না। কারণ আপনার পেটে খাদ্য নামক বস্তু যদি প্রবেশ না করান, আপনার বেঁচে থাকাটাই হবে না। আর আপনি বেঁচেই যদি না থাকেন আপনার বাসস্থান মৌলিক চাহিদা নিরর্থক হবে। তেমনিভাবে খাদ্য মৌলিক চাহিদা পূরণ হলেই বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার প্রয়োজন হবে। আর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই শিক্ষার প্রয়োজন। ফাঁকা মাঠে গোলকিপারবিহীন গোল করা যেমন অর্থহীন, তেমনিভাবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা ছাড়া শিক্ষাও অর্থহীন। শিক্ষার আলো তখনই ঘরে ঘরে জ্বলবে, যখন প্রত্যেকের ঘর থাকবে। নয়তো, যাদের ঘর আছে তাদের বাড়িতেই শিক্ষার আলো জ্বলবে বলতে হবে। ওপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হলাম জরুরি চাহিদা খাদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য চাহিদা সম্পর্কে। জরুরি চাহিদা খাদ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত চাষিদের নিয়ে আলোচনা করা যাক। কালি ছাড়া যেমন কলম মূল্যহীন, চিনি ছাড়া যেমন চা মূল্যহীন, ডিজেল ছাড়া যেমন ডিজেলচালিত যানবাহনের মূল্য নেই, তেমনি কৃষক ছাড়া খাদ্য উৎপাদন মূলহীন, অর্থহীন, মোটকথা শূন্য বলা যায়। খাদ্য উৎপাদন হতে হলে কৃষক লাগবেই। তাই কৃষক ও খাদ্য একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশের মধ্যে নিয়মিত খাবারে ভাত ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার অভ্যাস খুব কম বাংলাদেশির বা অভ্যাস নেই বললেই চলে। সেজন্য আমরা ভাতের বাঙালি স্বীকৃত। ভাত হয় চাল থেকে। আর চালের উৎপাদন দাতা চাষি। কিন্তু অনেক দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সব চালের ভাত চাষি খেতে পারে না। যারা উৎপাদন করে তারা খায় মোটা চালের ভাত আর যারা উৎপাদন করে না তারা খায় চিকন থেকে চিকনতর চালের ভাত। বর্তমান সময়েও বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের, ‘চাষার দুক্ষু’ প্রবন্ধের ‘ক্ষেতে ক্ষেতে পুইড়া মরির ভাই পাছায় জোটে না ত্যানা বৌ-এর পৈছা বিকায় তবু ছেইলা পায় না দানা।’ মহান কথাটি মনে পড়ে যায়। সামর্থ্য আছে, চাহিদা আছে, ক্রয়ক্ষমতা আছে চিকন চালের ভাত খাওয়ার, তাই খেতেই পারে, তাদের খাওয়ার বিপক্ষে নই আমি বরং পক্ষে। কারণ তারা চিকন চালের ভাত না খেলে কৃষকের জীবনও আর্থিকভাবে আশীর্বাদ হবে না। আমি বিপক্ষ হই তখনই চিকন চালের ভাত খেয়ে যখন চিকন চাল দাতার প্রশংসা করতে ভুলে যায়। তা ছাড়া, কৃষিকাজ যেহেতু আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু এক দিন ফসলের জমিতে ব্যস্ত না থাকা কৃষকের ওপর অনেক খারাপ প্রভাব তৈরি হওয়া মনে করা হয়। তাই বিভিন্ন ধরনের আনন্দের অনুষ্ঠান থেকে চাষিকে অনেক সময় দূরে থাকতে হয়।

পরিশেষে বলব, কোনোপ্রকার সন্দেহ ছাড়াই আমাদের দেশের চাষিরা দেশপ্রেমিক ও সবার চেয়ে বড় সাধক। তারা নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে রোদণ্ডবৃষ্টিতে কষ্ট করে আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। চাষির ত্যাগ ও সাধনা অতুলনীয়। তাই তাদের মর্যাদাও দেশ-সমাজের সবার ঊর্ধ্বে। সব পেশার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রেখে সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে- আসুন যাদের হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রমের উৎপাদিত খাদ্য আমরা খেয়ে বাঁচি, যারা তাদের আনন্দ-অনুষ্ঠান ত্যাগ করে খাদ্য উৎপাদন করে আমাদের বাঁচায় সেই মহান সাধকদের সর্বোচ্চ সম্মান দেখাই, শ্রদ্ধা করি ও প্রশংসা করি। সবাই ধন্য ধন্য বলি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কৃষক নামক মহান মানুষদের, সৃষ্টিকর্তার প্রেরণকারী চাষিদের।

শ্রদ্ধেয় রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর অমর লেখা ‘চাষি’ কবিতার দুই লাইন নিচে কৃষকদের সম্মানার্থে স্মরণ করে আমার কৃষকের প্রতি প্রশংসা এখানেই শেষ করছি।

‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,

দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।’

লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close